আমার গল্পগুলোঃ একাডেমিক
// শুধু একাডেমিক
বাকী দশজনের মতো আমার ছেলেবেলাটা খুব বেশি রঙ্গিন ছিলো না। পিছনে ফিরে তাকালে আমার বেশ বোরিংই লাগে৷ তবে এটা নিয়ে আমার কোন আক্ষেপ নেই। কারণ জিনিসটাকে উলটা করে বললে দাঁড়ায় দিন দিন আমার জীবন আরো রঙ্গিন হচ্ছে। 🤣
স্কুল লাইফটা বোরিং হলেও আমি খুব দুঃখী ছিলাম না। আমি কখনোই খুব একটা ভেবেচিন্তে কথা বলতাম না, অনেক অপ্রিয় কথা মুখের উপরই বলতাম যার জন্য হয়তো আমার স্কুল লাইফের ফ্রেন্ড অনেক কম। মোটামুটি ক্লিন শিট বজায় রাখার ট্রাই করলেও বেশ কয়েকবার আমার গার্জিয়ান ডাকানো হয়েছিলো, অনেক শাস্তিও পেয়েছি। মেজরিটিই মনে নেই। স্কুল লাইফে আমার উল্লেখযোগ্য কাজ বলতে ক্লাসে টপ করার জন্য নূন্যতম পড়ালেখা করা, বাসায় এসে গেম খেলা আর স্কুলের মাঠে ক্রিকেট খেলা, যদিও আমি জঘন্য খেলতাম। এর বাইরেও প্রচুর সময় পেতাম, সেগুলো কিভাবে নষ্ট করেছি আমার মনে নেই, তবে ওই টাইমে কোডিং আর অলিম্পিয়াড করলাম না কেন সেটা নিয়ে আমার আফসোস হয় এখন৷ এই আফসোসটা এমনকি কলেজ লাইফেও হয় নি, ভার্সিটি লাইফেই ফিল করি৷
সত্যি কথা বলতে আমি বলবো না আমি আমার স্কুলকে অনেক মিস করি কারণ আগেই বলেছি স্কুল লাইফে আমি তেমন কোন স্মৃতি তৈরী করি নি৷ তবে আমি আমার স্কুলের এবং স্কুলের বেশ কয়েকজন শিক্ষকের প্রতি কৃতজ্ঞ কারণ আমি এখন যা তার ভিত্তি আমার স্কুলটা। বেধ - বল - ধী যা কিছুই অর্জন আমি করেছি সেই সময়ে আমার স্কুলের তাতে অধিকার রয়েছে৷
তবে ৮ টা বছর একটা স্কুলে পড়তে পড়তে শেষের দিকে কেন যেন সবকিছু লিনিয়ার লাগতো। মনে হতো একটা চেঞ্জ দরকার। আর স্কুলের কিছু বিষয়ের প্রতি আমার বিরক্তিও চলে এসেছিলো। ফ্লেভার চেঞ্জ করার জন্য চলে আসলাম নটরডেম কলেজে৷ এটা আমার লাইফের জন্য খুবই কঠিন একটা ডিসিশান ছিলো কারণ আমার বাসা হতে কলেজে যাওয়া আসা করতে ৪ ঘন্টা লাগতো৷ DRMC ও কলেজ হিসেবে খুবই ভালো কাজেই এই যন্ত্রণা আমার ঘাড়ে নেওয়ার কোন দরকার ছিলো না। কিন্তু এখন ফিরে তাকালে আমি আমার ডিসিশান নিয়ে খুবই স্যাটিসফায়েড ফিল করি।
...................…....................................................
কলেজ লাইফে আমি নিজেকে আরো ইন্ট্রোভার্ট করে নিই৷ এই প্রথম জীবনে একটা লক্ষ্য নিয়ে আগাই এবং তা পাওয়ার জন্য যা করার দরকার করেছি, কখনো এক চুল কম্প্রমাইজও করি নি৷ কলেজ লাইফেও আমি দাবি করবো না খুব বেশি স্মৃতি তৈরী করেছি কিন্তু যতগুলো করেছি তার সবগুলো খুব কড়া ছিলো। আমাদের বাংলা ক্লাস নিতেন বাবু স্যার এবং ম্যাথ ক্লাস নিতেন রেজা স্যার। ইনাদের ক্লাসগুলোকে কখনো আমার ক্লাস মনে হয় নি, মনে হয়েছে জীবনের এক একটা অধ্যায়। এই ক্লাসগুলোর জন্য আমার প্রতিদিনের চার ঘন্টা যাওয়া অর্থহীন মনে হতো না। ফিজিক্স ল্যাবে ব্যাক ক্যালকুলেশন করে মিলাতাম, বায়োলজি ল্যাবে তেলাপোকার চৌদ্দগুষ্ঠী উদ্ধার করতাম, স্যাররা চোখেমুখে একগাদা আনন্দ নিয়ে মানবদেহের অস্থি চেনাতো, সেটা এখনো আমার চোখে ভাসে। ম্যাথ ল্যাবে ৮০-১০০ টা বিন্দু বসিয়ে গ্রাফ আকতাম। আমি কখনোই দাবি করবো না আমি জিনিসিগুলো সবসময় ভালোলাগতো, কিন্তু আমি যখন আবার মনে করতাম যে মানুষগুলো কতটা যত্ন নিয়ে আমাকে জিনিসগুলো শিখিয়েছিলো, আমি আবার গোড়া থেকে শুরু করতাম। যেমনটা আগে বলেছি, কখনো কলেজ লাইফে এক চুল কমপ্রমাইজও করি নি৷
কলেজ থেকে ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার সময়টা ছিলো আমার জীবনের কালো অধ্যায়। আমি চাই না এই ৫ মাস আর কারো জীবনে আসুক। বাংলাদেশের সব ছাত্রই জানে যে এই সময়ে প্রেশারটা কেমন থাকে। যাই হোক, সেটা আমি কখনো কেয়ার করতাম না, কিন্তু এর মাঝে আম্মার চিকুনগুনিয়া, বাবার হার্ট এটাক, আমার আক্কেল দাঁত ওঠা, এইচ এস সি তে ইংলিশে এ+ মিস সব মিলিয়ে জীবন আমাকে এমন পিঠ দেখায় যে আমি ডিপ্রেসড হওয়ার বদলে অবাক হয়ে ভাবি। প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার সময় ভাবতাম "Life, why me?" মারা খেতে খেতে যখন পিঠ আর পেট দুটোই শক্ত হয়ে গেলো, তখন প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার সময় বলতাম "Life, try me."
এরকম মুহূর্ততে অন্তত একটা ভালো সংবাদ লাগতো যেটা আমার কনফিডেন্সকে ব্যাক করায়। একটা খড়কুটো। আব্বাকে যখন চেন্নাইতে হার্টের ব্লক অপারেশন করে OT থেকে বের করা হলো, মা আব্বাকে ফোন দিয়ে জানায় যে আমি AUST এডমিশনে ফার্স্ট হয়েছিলাম। আমি শুধু তখন কল্পনা করছিলাম সিচুয়েশনটা। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে সন্তানের কামব্যাকের খবর শোনা - once in a lifetime, huh?
যদিও মেডিকেলের প্রিপারেশন নিই নাই, মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পাওয়াটা আমার জন্য ছিলো জ্যাকপট। যখন ঢাবির এক্সামটাতেও উতরে গেলাম, বুঝে গেলাম আমার আর পেটের চিন্তা নাই, বুয়েট এক্সামে জীবনের সমীকরণ মেলানো লাগবে না। বুয়েট এক্সামে প্যানিক করা তাই কমন ইস্যু হলেও আমার প্যানিক করা লাগে নাই। I was no more that afraid boy in backfoot. Next day, I just did what needed to be done. গেমপ্ল্যান অনুযায়ী নেমে গিয়েছিলাম। ৮ টা জৈব যৌগ এসেছিলো, ১৫ মিনিটের ভিতর নামিয়ে দিয়েছিলাম। ৩০-৪০ টা রুটিন প্রব্লেম ছিলো, টানা করে গেছি শ্রমিকের মত। নিজেকে সিরিয়াল কিলার মনে হচ্ছিলো, একটা একটা করে প্রব্লেম খুন করছিলাম। এমনকি লাস্ট ৪০-৫০ সেকেন্ডেও একটা ম্যাথ কিভাবে যেন করে আরো ১০ মার্ক তুলে ফেলেছিলাম, মোমেন্টাম আমার সাথে ছিলো। অবশ্য ৭-৮ টা মতো ক্যালকুলেশন মিস্টেকও করেছিলাম, তবে ৫৮ টা এন্সার করে আসায় অত ড্যামেজ হয় নাই।
এক্সাম শেষে একটা এক্সট্রা এক্সাম খাতা আমার সামনে রয়েছিলো যেটা আমি ইউজ করি নি। ইনভিজিলেটর সেটা দেখে আমাকে কড়া ধমক দিয়েছিলো যে আমার জন্য তার খাতার হিসাবে গরমিল হয়েছে, সন্দেহও করেছিলো হয়তো আমার অসৎ উপায় গ্রহণ করার চেষ্টা করেছিলাম কিনা। আমি যতটা পেরেছিলাম নিজেকে ডিফেন্ড করেছিলাম, জানতাম না কনভিন্স করতে পেরেছিলাম কিনা। ভেবেছিলাম আমার খাতাই হয়তো চেক করবে না, এক্সপেল করে দিবে। হলের বাকি পরিক্ষার্থীরা এমনভাবে চেয়েছিলো যে আমার চান্স শেষ।
দশ দিন পর রেজাল্টের দিনটা যে কেমন ছিলো সেটা এখানে লিখে বুঝানো কঠিন। মেন্টাল স্ট্যাবিলিটি আর প্যানিক কমানোর জন্য এক্সপেক্টেশন কম রেখেছিলাম। কখনোই আশা করি নি যে পজিশনটা দুই ডিজিটের ভিতর চলে আসবে। এটা আমার জন্য একটা মুক্তি ছিলো - মানসিক, অর্থনৈতিক, পরিবারে নিজের অবস্থান, সামাজিক - সব দিক থেকেই । যাই হোক জীবন আর আমাকে হতাশ করতে পারে নি। আমি কখনো কম্প্রমাইজ করি নি, এটাই আমার কাছে ইমপরট্যান্ট। জানি না সামনে কি হবে, কিন্তু আমি আর ভয় পাই না।
"আমাদের গেছে যে দিন
পুরোটাই কি গেছে?
কিছুই কি নেই বাকি?"
একটুকু রইলেম চুপ করে;
তারপর বললেম,
"রাতের সব তারাই আছে
দিনের আলোর গভীরে।"