Sapiens Synopsis Final Episode: The Scientific Revolution - Part II



The Wheels of Industry

আধুনিক অর্থনীতি বিকাশের জন্য আমরা আমাদের ভবিষ্যতের প্রতি আস্থা এবং উৎপাদনের মুনাফা পুনরায় বিনিয়োগের পুঁজিবাদীদের ইচ্ছাকে ধন্যবাদ। তবুও তা যথেষ্ঠ নয়। অর্থনীতির বিকাশের জন্য চাই শক্তি ও কাঁচামাল এবং এগুলি সীমিত। যখন এগুলি ফুরিয়ে যাবে তখন সমগ্র ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে। কিন্তু অতীত থেকে আমরা প্রমাণ পাই যে এগুলি কেবল তত্ত্বগতভাবেই সীমিত। পাল্টা জবাবে বলা যায় যে গত কয়েক শতাব্দীতে যখন মানবজাতির শক্তি ও কাঁচামালের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছিলো, আমাদের ব্যবহারের জন্য এগুলোর পরিমাণও আসলে বৃদ্ধি পেয়েছিলো। যখন উভয়েরই ঘাটতি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে হ্রাস করার হুমকি দেয়, তখন বিনিয়োগ বিজ্ঞান ও গবেষণার কাছে ঋণী হয়। পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠার পর আমরা যখন রিসোর্সের অভাবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, শিল্প বিপ্লব আমাদের জন্য আশির্বাদ হয়ে এসেছিল।

 শিল্প বিপ্লবের হাজার বছর আগে থেকেই মানুষ একটি বিশাল শক্তির উৎসের ব্যবহার সম্পর্কে জেনে গিয়েছিলো। তবুও এগুলোর সুস্পষ্ট সীমা ও সমস্যা ছিলো। শিল্প বিপ্লবের আগে মানুষের শক্তির বাজার ছিলো সম্পূর্ণভাবে উদ্ভিদ আর সূর্যের উপর নির্ভরশীল। শিল্প বিপ্লবের পর আমরা বুঝতে পেরেছিলাম আমরা আসলে শক্তির এক মহাসাগরে বাস করছি, আমাদের কেবল একটি উন্নততর পাম্প আবিষ্কার করতে হবে। নবম শতাব্দীতে বারুদ উদ্ভাবন হলেও সেটি থেকে বন্দুক উদ্ভাবন করতে আরো ৬০০ বছর লেগেছিলো। ১৭০০ সালের দিকে বাষ্প ইঞ্জিন খনিতে ব্যবহারে সীমাবদ্ধ থাকলেও সেটি যখন বস্ত্র শিল্পে অবদান রাখা শুরু করে, বিপুল পরিমাণ সস্তা কাপড় উৎপাদন করে বৃটেন হয়ে উঠে বিশ্বের কর্মশালা৷ এরপর বৃটিশরা যখন বাষ্প ইঞ্জিনকে পুঁজি করে রেলওয়েতে বিপ্লব ঘটায়, অর্থনীতিতে তারা তাদের সিংহাসন আরো পোক্ত করে। তবে আরো efficient internal combustion engine বা IC ইঞ্জিন আবিষ্কারের পর ইতিহাসের মোড় ঘুরে যায়। আগে মানুষ যুদ্ধ করতো স্বর্ণ, গোলমরিচ অথবা কৃতদাস নিয়ে, এরপর যুদ্ধের উপজীব্য হয় তেল ও পেট্রোলিয়াম।

১৮২০ সালে রসায়নবিদরা এলুমিনিয়াম আবিষ্কার করেছিলেন, কয়েক দশক ধরে এলুমিনিয়াম ছিলো স্বর্ণের চেয়েও মূল্যবান। ১৮৬০ দশকে ফ্রান্সের সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন তার বিশিষ্ট অতিথিদের জন্য এলুমিনিয়ামের কাটলারি ব্যবহার করতেন, আর সাধারণ প্রজাদের জন্য স্বর্ণের কাটলারি ব্যবহার করতেন। তবে উনবিংশ শতাব্দীর শেষে সস্তায় এলুমিনিয়াম নিষ্কাষণের উপায় বের করে ফেলেছিলেন রসায়নবিদরা। নেপোলিয়ন শুনলে অবাক হবেন যে তার গরীব প্রজাদের বংশধররা এখন এলুমিনিয়াম ফয়েল দিয়ে শর্মা আর স্যান্ডুইচ র‍্যাপ করে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিলো। ফলে কাঁচামালের তীব্র সংকট পড়েছিলো। জার্মানদের সৌভাগ্য যে তাদের একজন নাগরিক, ফ্রিটজ হেবার ১৯০৮ সালে এমোনিয়া উৎপাদনের প্রক্রিয়াটি আক্ষরিক অর্থে বলতে গেলে হাওয়া থেকে আবিষ্কার করেছিলেন। যুদ্ধের সময় জার্মানরা হেবারের আবিষ্কারটি ব্যবহার করে বিস্ফোরক উৎপাদন শুরু করলো। এটির কাঁচামাল ছিলো বায়ু (নাইট্রোজেন আরকি)। কিছু গবেষক মনে করেন হেবারের আবিষ্কারটি না হলে জার্মানি ১৯১৮ এর অনেক আগেই আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হতো। এই আবিষ্কারের জন্য তিনি ১৯১৮ সালে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন, শান্তিতে নয়, কেমিষ্ট্রিতে।

 শিল্প বিপ্লবের আগে প্রায় সব সমাজে জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ ছিলো কৃষক। আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনসংখ্যার মাত্র ২ শতাংশ চাষাবাদের উপর নির্ভর করে জীবন ধারণ করে থাকে। তবে এই ২ শতাংশ মানুষের উৎপাদিত পণ্য কেবল যুক্তরাষ্ট্রের সকল জনগণের চাহিদাই মেটায় না, সারা বিশ্বে উদ্বৃত্ত খাদ্য রপ্তানিও করে। মানব ইতিহাসে প্রথমবারের মত চাহিদার থেকে সরবরাহ বেশি হতে শুরু করলো। অতঃপর একেবারে নতুন সমস্যার জন্ম নিয়েছিল ঃ কারা এত সব জিনিস কিনবে?

আধুনিক পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এটিকে অবশ্যই ক্রমাগত বৃদ্ধি করতে হবে, যেমন হাঙ্গরকে অবশ্যই সাঁতরাতেই হবে নয়তো দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে। কিন্তু উৎপাদন করাই যথেষ্ঠ নয়, কাউকে না কাউকে কিনতেও হবে, ফলে নতুন এক ট্রেন্ড শুরু হলো- ভোক্তাবাদ। ইতিহাস জুড়ে অধিকাংশ মানুষই অভাবের মাঝে জীবন যাপন করেছে, মিতব্যয়ীতা ছিলো তাদের নীতিবাক্য। পিউরিটান ও স্পার্টানের সংযমের নীতি হচ্ছে দুইটি বিখ্যাত উদাহরণ। এখন যেসব পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখে আমরা আকৃষ্ট হই, ইতিহাসের বেশিরভাগ সময় জুড়ে মানুষ তা প্রত্যাখ্যান করেছে। 'নিজের ইচ্ছার দামটাই আসল, মিতব্যয়িতা হলো এক ধরনের আত্মপ্রবঞ্চনা' - এই বিশ্বাস আমাদের মাঝে ঢুকিয়ে দিয়ে ভোক্তাবাদ এখন রাজত্ব করছে। আমরা এখন অগণ্য পণ্য কিনতে পারি যা আসলেই আমাদের প্রয়োজন হয় না, আর গতকাল পর্যন্ত এর অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণাই ছিলো না। ক্রিসমাসের মত খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় ছুটির দিনগুলি এখন শপিং উৎসবে পরিণত হয়েছে। এখন স্থূলতা ধনীদের চেয়ে দরিদ্রদের বেশি হচ্ছে, কারণ ধনীরা খায় এখন অর্গানিক সালাদ আর ফলের জুস, দরিদ্ররা খায় হ্যামবার্গার আর পিজ্জা। প্রতি বছর বিশ্বে ক্ষুধার্থ লোকদের খাওয়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণের তুলনায় মার্কিন জনগণ ডায়েট কন্ট্রোলে বেশি অর্থ ব্যয় করে। মেদবহূলতা হচ্ছে ভোগবাদের জন্য দ্বিগুণ বিজয়। মানুষ কম খেলে অর্থনৈতিক সংকোচন ঘটে, কিন্তু বেশি খেয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াচ্ছে এবং আবার জিমে গিয়ে আরো প্রবৃদ্ধি বাড়াচ্ছে।

মধ্যযুগের ইউরোপে অভিজাতরা অর্থ ব্যয় করতো এলোমেলো অতিরিক্ত বিলাসে, অথচ কৃষকরা দারিদ্র‍্যের মাঝে প্রতিটি পেনি ভেবেচিন্তে ব্যয় করতো। এখন ধনীরা তাদের সম্পদ ও বিনিয়োগ ব্যবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে, অথচ নিম্ন মধ্যবিত্তরাও গাড়ি ও টেলিভিশন কিনে আনে যা তাদের প্রয়োজন নেই।

পুঁজিবাদী ভোক্তাবাদী নৈতিকতা অন্য একটি দৃষ্টিকোণ থেকে বৈপ্লবিক। বেশিরভাগ খ্রিষ্টানই খ্রীষ্টকে অনুসরণ করে নি, বেশিরভাগ বৌদ্ধই বুদ্ধকে অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে, অধিকাংশ কনফুসিয়ানই কনফুসিয়াসকে ক্ষুদ্ধ করতে পারে। কিন্তু ভোক্তাবাদের ধর্ম ধনীকে লোভী থেকে আরো ব্যবসা করার জন্য এবং জনগনকে আরো কেনাকাটা করার জন্য পুরষ্কৃত করে। ইতিহাসে এটি হলো প্রথম ধর্ম যার অনুসারীরা আসলে যা চায় তা করতে পারে।

 

The Permanent Revolution

আজ থেকে মিলিয়ন বছর পর হয়তো বুদ্ধিমান ইঁদুররা পিছনে তাকিয়ে মানবজাতির ধ্বংসের কথা (নিজেদের কারণে) কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে। ঠিক যেমন আজ আমরা ডাইনোসরদের বিলুপ্তির জন্য গ্রহাণুর কাছে কৃতজ্ঞ। তবে পৃথিবী থেকে মানুষের বিলুপ্তি হয়ে যাওয়ার গুজব এখনো অতটা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারে নি।

 প্রাচীনকালে মানুষের ঘন্টা বা দিন দূরে থাক, কোন টাইম ট্রাভেলার যদি মধ্যযুগীয় একটি গ্রামে উদয় হয়ে জিজ্ঞেস করতো 'এটা কোন বছর?', এই প্রশ্ন শুনে গ্রামবাসীরা বিস্মিত হতো। আজকের আধুনিক কর্মশালা প্রতিটা মিনিটের উপর নির্ভরশীল এবং এর কারণও আছে। মধ্যযুগে কোন মুচি একটা জুতা সম্পূর্ণ নিজেই বানাতো। আধুনিক যুগে কারখানায় অনেক কর্মী জুতার ভিন্ন অংশ পর্যায়ক্রমে বানায়, কাজেই ৫ নাম্বার কর্মী যদি বেশি ঘুমিয়ে যায়, পুরো জুতো বানানোর প্রক্রিয়াই বন্ধ হয়ে যাবে।

১৮৮০ সালে বৃটেনের সকল টাইমটেবিল গ্রীনউইচকে অনুসরণ করে, ইতিহাসে প্রথমবারের মত একটি দেশ একটি জাতীয় সময় গ্রহণ করে। এর উপর ভিত্তি করে রেডিও সম্প্রচার ও টেলিভিশন প্রচারও শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রতিভাবান জার্মান পদার্থবিজ্ঞানীরা বিবিসি নিউজের সরাসরি বিগ বেনের ঘন্টার ধ্বনির শব্দ শুনে লন্ডনের আবহাওয়া সম্পর্কে ধারণা করার একটি উপায় বের করেছিলো যা Luftwaffe কে সুবিধা দেয়। বিবিসি আবার সেটি বুঝে ফেলে অন্য দিনের রেকর্ডেড ঘন্টার শব্দ প্রচার করতো।

ইউরোপে মধ্যযুগীয় শহরগুলোতে একটি করে ঘড়ি থাকত এবং ঘড়িগুলো যাচ্ছেতাই ভুল সময় দেখালেও তেমন অসুবিধা হতো না কারণ ওই শহরে আর কোন ঘড়ি ছিলো না। এখন একটা নিম্নবিত্ত বাড়িতেও মধ্যযুগীয় শহরের চেয়ে বেশি ঘড়ি থাকে। শিল্পবিপ্লব মানব সমাজে ডজনখানেক পরিবর্তন ঘটিয়েছিলো। কারখানায় সময়ের ব্যবহার ছিলো এগুলির মাঝে একটি। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হচ্ছে নগরায়ন, কৃষক সম্প্রদায়ের অন্তর্ধান, কারখানার শ্রমিকের উত্থান, সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়ন, গণতন্ত্রীকরণ, যুব সংস্কৃতি ও পিতৃতন্ত্রের হ্রাস।

শিল্প বিপ্লবের আগে অধিকাংশ মানুষ পারিবারিক ব্যবসায় নিয়োজিত থাকতো। একটা পরিবার ছিলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নির্মাণ, অর্থনীতি সব দিক থেকেই কমপ্লিট ইউনিট। যেটা পরিবারের আয়ত্তের বাইরে ছিলো, তার জন্য স্থানীয় সম্প্রদায় এগিয়ে আসতো। তবুও দশ শতাংশেরও কম পণ্য ও সেবা মানুষ বাজার থেকে কিনতো। পরিবার এত শক্তিশালী ছিলো যে অটোমান সাম্রাজ্যে গৃহবিবাদ নিরসন ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য বিচারিক ক্ষমতা পরিবারগুলোকেই দিতো রাজকীয় পুলিশবাহিনীর বদলে। এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছিলো, আমার কাজিন যদি কাউকে মেরে ফেলে, তবে ভুক্তভোগীর ভাই আমাকে মেরে ফেলার অধিকার রাখে। ইস্তাম্বুলের সুলতান বা প্রাদেশিক রাজ প্রতিনিধি এই ধরনের সংঘর্ষে হস্তক্ষেপ করতেন না, যতক্ষণ না গ্রহণযোগ্য সীমা অতিক্রম করে। কোন নারী যদি ১৭৫০ এর কাছাকাছি সময়ে তার পরিবার ও সম্প্রদায়কে হারিয়ে ফেলত, তাকে কার্যত মৃত মনে করত। যে সকল ছেলেরা বাড়ি থেকে পালিয়ে যেত, তারা বড়জোর কোন নতুন পরিবারে ভৃত্য হিসেবে একটি চাকরি আশা করতে পারতো। গত দুই শতাব্দী ধরে এইসব বিষয়ে নাটকীয় পরিবর্তনগুলি হয়েছিল।

পিতামাতা ও সম্প্রদায়ের প্রবীণরা তরুণ প্রজন্মকে জাতীয়তাবাদী শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত হতে, সৈন্যবাহিনীতে নিয়োজিত হতে অথবা শিকড়হীন শহুরে শ্রমজীবী শ্রেণীতে পরিণত হতে উৎসাহিত করতে শুরু করে। সময়ের সাথে রাষ্ট্র ও বাজারগুলি ক্রমবর্ধমান শক্তিকে পরিবার ও সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যগত বন্ধনকে দুর্বল করার জন্য ব্যবহার করেছে। রাষ্ট্র ও বাজার এমন একটি প্রস্তাব নিয়ে এলো যা প্রত্যাখ্যান করা যেত না। তারা বললো, 'ব্যক্তি হয়ে উঠুন। পিতামাতার ইচ্ছা ছাড়াই আপনি যাকে ইচ্ছা বিয়ে করতে পারেন। আপনি পরিবারের উপর নির্ভরশীল নন। আমরা আপনাকে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা দিবো।' তবে আধুনিক পরিবার এখনো ব্যক্তির একান্ত চাহিদাগুলি পূরণ করে থাকে, রাষ্ট্র ও বাজার ব্যবস্থা এসব চাহিদা পূরণ করতে পারে না।

রোমান্টিক যুগের সাহিত্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একজন ব্যক্তিকে রাষ্ট্র ও বাজার ব্যাবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত একজন মানুষ হিসেবে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। এর চেয়ে মিথ্যা আর কিছু হতে পারে না। রাষ্ট্রই প্রথম ব্যক্তি স্বাধীনতার বিকাশ ঘটায়, খাদ্য, আশ্রয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য,কল্যাণ, চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়৷ ইতিহাসের অধিক পাতাজুড়েই নারীদের পণ্য হিসেবে গণ্য করা হতো, পরিবারতান্ত্রিক ব্যবস্থা হতে রাষ্ট্রভিত্তিক ব্যবস্থায় যাওয়ার পর এই চিত্র পাল্টাতে শুরু করে।

তবে এই পরিবর্তনে আগে যেখানে পরিচিত সম্প্রদায়ের মাঝে মানুষ বিচরণ করতো, সেখানে এখন একেবারে অপরিচিত লোকজন নিয়ে গড়া রাষ্ট্র ও বাজার ব্যবস্থার সদস্যরা পরস্পরের জীবনে খুব সহজেই প্রভাব ফেলতে পারে। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বিবর্তন আমাদেরকে সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে বাস ও চিন্তা করতে শিখিয়েছে। মাত্র দুই শতাব্দীর মধ্যে আমরা বিচ্ছিন্ন সত্তায় পরিণত হয়েছি। এটিই হলো সংস্কৃতির সবচেয়ে অসাধারণ ক্ষমতা।

বাজার ব্যবস্থা মানুষের রোমান্টিক ও যৌন জীবনকে আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি নিয়ন্ত্রণ করছে। আগের দিনে বর ও কনের পরিবারের ড্রয়িং রুমে সাক্ষাৎ হতো, এক পিতার হাত থেকে অর্থ প্রবাহিত হতো আরেক পিতার হাতে। এখন প্রণয়প্রার্থী সাক্ষাৎ করে বার অথবা ক্যাফেতে, আর প্রেমীদের হাত থেকে অর্থ চলে যায় রেস্টুরেন্টে। আগে যদি পিতামাতা সন্তানদের শারীরিক আঘাত করতো, রাষ্ট্র তাতে হস্তক্ষেপ করলে একটা হাস্যরসের ব্যাপার হতো। আধুনিক যুগে আবার তৈরী হচ্ছে কাল্পনিক সম্প্রদায়, যারা পরস্পরকে না চিনলেও একই ধরনের আচরণ করে, যেমনঃ নিরামিষভোজী, মেসির ভক্ত, পরিবেশবাদী প্রমুখ।

চার্লস ডিকেন্স ফরাসী বিপ্লব সম্পর্কে লিখেছেন 'এটি ছিলো শ্রেষ্ঠ সময়, আর এটিই ছিলো সবচেয়ে খারাপ সময়।' হয়তো এটি কেবল ফরাসী বিপ্লবের ক্ষেত্রে সত্যি নয়, বরং সব যুগের ক্ষেত্রেই সত্যি। এই সময় দুইটা বিশ্বযুদ্ধ এবং বহু গণহত্যা সত্ত্বেও এই দশকগুলিতে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিবর্তনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে। লক্ষ্যণীয় বিষয়, স্থানীয় অপরাধ আন্তর্জাতিক যুদ্ধ থেকেও অনেক বেশি মারাত্মক হুমকি এবং পৃথিবীতে যত মানুষ হত্যা হয়, তার চেয়ে বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে। ইতিহাসের টেকটোনিক প্লেটগুলি ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে চলেছে, কিন্ত আগ্নেয়গিরিগুলি বেশিরভভাগ সময় নীরব থেকেছে।

আস্তে আস্তে সাম্রাজ্যবাদের বিলুপ্তি ঘটতে শুরু করে। ১৯৪৫ সালের থেকে বেশিরভাগ সাম্রাজ্যগুলি শান্তিপূর্ণভাবে অবসরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ১৯৪৫ সালে বৃটেন বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ শাসন করতো, এখন তারা মাত্র কয়েকটি ছোট দ্বীপ শাসন করছে। তারা ক্ষমতা বজায় রাখার পরিবর্তে শান্তিপূর্ণভাবে হস্তান্তরে মনযোগ দিয়েছিলো। ফরাসী সাম্রাজ্য ছিলো বেশি একগুঁয়ে, ভিয়েতনাম ও আলজেরিয়ায় এর পতন ঘটেছে রক্তাক্ত সংঘর্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনের বিনিময়ে। বলকান, ককেশাস, মধ্য এশিয়ার জাতিগত দ্বন্দ্ব থাকা সত্ত্বেও ১৯৮৯ সালে সোভিয়েতের পতন ছিলো আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সোভিয়েত সাম্রাজ্য আফগানিস্তান ছাড়া কোথাও সামরিক পরাজয়ের স্বীকার হয় নি, বহিরাগত আক্রমণ, বিদ্রোহ বা মার্টিন লুথার কিং এর অসহযোগ আন্দোলনের মত কিছুরও মুখোমুখি হয় নি। সোভিয়েতের হাতে লক্ষ লক্ষ সৈন্য ও সমগ্র মানবজাতিকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলার মত পর্যাপ্ত পারমাণবিক বোমা থাকা সত্ত্বেও তারা চড়াও হয় নি, কমিউনিস্ট শাসকগণ উপলব্ধি করেন কমিউনিজম দেউলিয়া হয়ে গেছে এবং ব্যর্থতা মেনে নিয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে প্রত্যাবর্তন করে। গর্বাচেভ যদি আলজেরীয় ফরাসীদের মত আচরণ করতেন, তাহলে কি ঘটতে পারতো, চিন্তা করতেও আতংকবোধ হয়।

 ১৯৪৫ সালের পর যুদ্ধ অনেক কমে যায়, কারণ পৃথিবী এখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উপর ফোকাসড। আর যে ক্যালিফোর্নিয়া গড়ে উঠেছিলো স্বর্ণ খনির উপর ভিত্তি করে, সেখানে আজ সিলিকন ও সেল্যুলয়েডের উপর নির্মিত সিলিকন ভ্যালিতে সশস্ত্র আক্রমণ করলে কমই লাভ হবে। যুদ্ধ যখন কম লাভজনক হয়ে পড়লো, শান্তি তখন আগের তুলনায় আরো বেশি লাভজনক হয়ে উঠলো। যতদিন চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শান্তি বজায় থাকবে, চীনারা যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য বিক্রি, ওয়ালস্ট্রিটে বাণিজ্য এবং মার্কিন বিনিয়োগ লাভ করে সমৃদ্ধ হতে পারবে। ইতিহাসে আমাদের সময়েই প্রথম কোন শান্তিপ্রিয় অভিজাত শ্রেণী পৃথিবী শাসন করছে। আন্তর্জাতিক দৃঢ় সংযোগ অধিকাংশ দেশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করলেও এটি তাদের কোন এক ব্যক্তি এককভাবে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্ভাবনাকে হ্রাস করেছে। সাম্রাজ্যবাদের পতনের পর জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত কোন স্বাধীন দেশ অন্য দেশের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যায় নি। প্রকৃত শান্তি কেবল যুদ্ধের অনুপস্থিতি নয়, প্রকৃত শান্তি হচ্ছে যুদ্ধের অযৌক্তিকতায়। ১৮৭১-১৯১৪ এর সময়গুলো বাজেভাবে শেষ হয়েছিলো, শান্তি বিরাজ করে নি। এখন সমগ্র বিশ্ব বিবেচনা করলে প্রকৃত শান্তি বিরাজ করছে, কারণ শুধু যুদ্ধের অনুপস্থিতি নয়, সম্ভাবনাও ক্ষীণ। সব ধরনের শান্তি পুরষ্কারের প্রয়োজনীয়তা শেষ করে দেওয়ার জন্য পারমানবিক বোমার স্থপতি রবার্ট ওপেন হেইমার ও তার সহযোগীদের নোবেল প্রাইজ দেওয়া দরকার ছিলো। কারণ অস্ত্র যখন এত শক্তিশালী হয়ে যায় যে পুরো পৃথিবীকে ধ্বংস করতে পারে, টেকনিক্যালি সেটা তার কার্যক্ষমতা হারায়।

And They Lived Happily Ever After

মানবজাতি আজ যে ধরনের সম্পদ ভোগ করছে তা রূপকথার গল্পের উপাদান হিসেবে ব্যবহার হতো। কিন্তু আমরা কি সুখী? ৩০ হাজার বছর আগে Chauvet গুহায় যার হাতের ছাপ রয়েছে, তার চেয়ে বায়ুহীন চাঁদের বুকে ফুটপ্রিন্ট অক্ষত থাকায় পরলোকগত নীল আর্মষ্ট্রং বেশি খুশি ছিলেন? যদি না হয়ে থাকেন তাহলে, কৃষিকাজ শহর, সাহিত্য, মুদ্রা, সাম্রাজ্য, বিজ্ঞান ও শিল্প উন্নয়নের যুক্তি কি?

মতাদর্শ ও রাজনৈতিক প্রোগ্রামসমূহ নিঃসন্দেহে সুখ সম্পর্কে যুক্তিহীন ধারণা দেয়। জাতীয়তাবাদীরা মনে করে, রাজনৈতিক স্বনির্ভরতা আমাদের সুখের জন্য অনিবার্য। কমিউনিস্টরা মনে করে সর্বহারা একনায়কতন্ত্রের অধীনে সবাই সুখী হবে। শিশু মৃত্যুহার ৩৩% থেকে ৫% এ নেমেছে, যা হয়তো পরিবারে সুখ বৃদ্ধি করেছে, আবার কমিউনিস্ট চীনে ১৯৫৮-৬১ সালের গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড অভিযানের সময় ১০ থেকে ৫০ মিলিয়ন মানুষ অনাহারে মারা গিয়েছিলো, এটা কি দুঃখের কারণ নয়?

একটি আকর্ষণীয় ধারণা হচ্ছে অর্থ সুখ নিয়ে আসে। কিন্তু এটি একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত, এই সীমা অতিক্রম করার তাৎপর্য খুব সামান্য। আপনার বেতন যদি ২৫ হাজার টাকা হয় এবং আপনার বেতন যদি ডাবল করা হয়, আপনি খুব খুশি হবেন। কিন্তু আপনার বেতন যদি দশ লাখ টাকা হয় বেতন ডাবল করলেও আপনার সুখ কয়েক সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হবে না। আবার সদয় সঙ্গী, আন্তরিক পরিবার ও প্রাণবন্ত গোষ্ঠীর সাহচর্যে থাকা একজন দরিদ্র পঙ্গু ব্যক্তি, একজন একাকী বাস করা ধনী ব্যক্তির চেয়েও ভালো থাকতে পারে।

আবার, আপনি যদি ৫০০০ হাজার বছর আগের কোন একটি ছোট গ্রামের আঠারো বছর বয়সী তরুণ হতেন, আপনি নিজেকে সবচেয়ে সুদর্শন মনে করতেন কারণ সে গ্রামে মাত্র ৫০ জন পুরুষ এবং তাদের বেশিরভাগই বৃদ্ধ, ক্ষতবিক্ষত ও মুখে ভাঁজযুক্ত মানুষ৷ কিন্তু আপনি যদি আজকের কিশোর হন, আপনি আপনার স্কুলের সবচেয়ে হ্যান্ডসাম ছেলে হলেও খুশি হবেন না, কারণ টেলিভিশন আপনাকে জানিয়ে দিয়েছে ক্রিষ্টিয়ানো রোনালদো বা ব্র‍্যাডপিট আপনার চেয়ে অনেক সুন্দর। আবার দেখুন, দ্বিতীয় র‍্যামসেস বা ক্লিওপেট্রার শাসনামলের তুলনায় হোসনি মোবারকের আমলে সাধারণ মিশরীয়দের অনাহার, মহামারী ও সহিংসতায় মারা যাওয়ার সম্ভাবনা কম ছিলো। কিন্তু তারা ফ্যারাওদের শাসনামলের সাথে নিজেদের অবস্থার তুলনা করে নি, বরং তারা ওবামার আমেরিকায় বসবাসকারী সমসাময়িকদের সাথে তুলনা করেছিল। যদি তাই হয়, তাহলে অমরত্ব পেলেও আমাদের অসন্তোষ যাবে না।

বাস্তবে কিন্তু লটারি জিতে, প্রমোশন পেয়ে বা ভালোবাসা খুজে পেয়ে কেউ সুখী হয় নি। সুখ হলো মানবদেহের বায়োকেমিক্যাল রিয়েকশন। যেমন, যৌন সঙ্গম করে আমরা জিন পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে দিই, বিবর্তন তার জন্য পুরষ্কাররূপে এক ধরনের সুখের অনুভূতি দেয়। বায়োকেমিস্ট্রি এমনভাবে কাজ করে যেন আমাদের সুখের মাত্রা একটি অপেক্ষাকৃত সেট পয়েন্ট থাকে। স্থির জায়গাটি একেক মানুষের জন্য একেক রকম। কেউ হয়তো দূষিত শহরে বাস করে স্টক এক্সচেঞ্জে সব শেয়ার হারিয়ে ডায়াবেটিস রোগী হয়েও সুখী, কেউ হয়তো লটারিতে কয়েক কোটি ডলার জিতে এথলেটের মত ফিটনেস নিয়েও গোমড়ামুখো। গাড়ি, লটারি, পেন্ট হাউস আমাদের বায়োকেমিস্ট্রি চেঞ্জ করে না, শুধু ক্ষণিকের জন্য সেট পয়েন্ট থেকে সুখের মাত্রার বিচ্যুতি ঘটায়, সেরাটোনিনের ক্ষরণমাত্রাই আসল। যারা আনন্দদায়ক বায়োকেমিস্ট্রি নিয়ে জন্মেছে, তাদের বিয়ে করার সম্ভাবনাও বেশি থাকে। বিপ্লব কি মানুষকে সুখী করে? জানি না। কিন্তু আমরা যদি ব্রেন কেমিস্ট্রি বুঝতে ও যথাযথ চিকিৎসা আবিষ্কার করতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করি, তাহলে আমরা হয়তো আগের থেকে অনেক সুখী হবো, কোন প্রকার বিপ্লবের প্রয়োজন ছাড়াই।

জীবনের প্রতিটি মিনিট মূল্যায়ন করলে মধ্যযুগের মানুষের জীবন অবশ্যই বেশ কঠিন ছিলো, কিন্তু সুখের প্যারামিটারে তারা ভালো মার্কস পাবেন কারণ তারা পরজন্মে অনন্তকাল আনন্দের প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করতেন। মধ্যযুগীয়রা জীবনের অর্থ খুজে পেলেও আজ আমরা একটি বিশুদ্ধ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে জানি, মানুষের জীবনের কোন অর্থ নেই। মানুষ হচ্ছে অন্ধ বিবর্তন প্রক্রিয়ার ফল, যার কোন লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নেই। আমাদের ক্রিয়াকলাপ কোন স্বর্গীয় মহাজাগতিক পরিকল্পনার অংশ নয়, আর যদি কোন কারণে পৃথিবী নামক গ্রহটি আগামীকাল সকালে ধ্বংস হয়ে যায়ও, মহাবিশ্ব যথারীতি তার কার্যকলাপ বজায় রাখবে। অতএব মানুষ তাদের জীবন সম্পর্কে যে ধারণাই করুক না কেন সবই বিভ্রম। এটি একেবারেই হতাশাজনক উপসংহার। সুখ কি আসলেই সেল্ফ-ডিলিউশনের উপর নির্ভর করে?

সেইন্ট পল এবং অগাস্টিন ভালোভাবেই জানতেন ইশ্বরের কাছে প্রার্থনা করার চেয়ে যৌনতা অধিক সুখের, তবুও কেন তারা ইশ্বরের প্রার্থনাকে রেকমেন্ড করতেন অসুখী মানুষের কাছে? বৌদ্ধধর্ম সম্ভবত অন্য যে কোন ধর্ম থেকে সুখের প্রশ্নটিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। একজন মাদবসেবীর কাছে হেরোইনই সুখের কারণ, তবে কি মনস্তাত্ত্বিকরা এই কথা মেনে নেবেন যে হেরোইনই সুখের চাবিকাঠি? বেশিরভাগ পুরুষ তাদের জীবন কাটায় পরিশ্রম, উদ্বেগ, প্রতিযোগিতা এবং যুদ্ধ করে কারণ DNA তাদের পরিচালিত করে নিজেদের স্বার্থপর লক্ষ্য পূরণের জন্য। তাহলে এই ক্ষণস্থায়ী পুরস্কার কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? কোন কিছু পাওয়ার জন্য কেন আমরা এত কঠোর সংগ্রাম করি যা কিনা পাওয়ার সাথে সাথেই বিলীন হয়ে যায়? আধুনিক বায়োলজি ও নিউ এজ মুভমেন্টের ধারণার সাথে বুদ্ধ একমত যে সুখ বাইরের অবস্থা থেকে মুক্ত। বৌদ্ধধর্ম অনুযায়ী ব্যথা বা বিষণ্ণতার অনুভূতি অথবা অর্থহীনতা দুঃখের মূল কারণ নয়৷ বরং ক্ষণস্থায়ী অনুভূতির পিছনে অবিরাম ও উদ্দেশ্যহীন এই ছুটে চলাই মূল কারণ।

The End of Homo Sapiens

প্রাকৃতিক নির্বাচনের জায়গা এখন দখল করেছে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং। গত চার বিলিয়ন বছরে এই গ্রহে কোন জীব ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনারের সৃষ্টি নয়, যেমন জিরাফের গলা লম্বা হওয়ার জন্য বর্তমান জিরাফরা সুপার-ইন্টেলিজেন্টের খেয়ালি আচরণের চেয়ে আদিম জিরাফদের প্রতিযোগিতার কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু সেপিয়েন্সরা নিয়ন্ত্রিত প্রজননের মাধ্যমে যে মোটা ও ধীরগতির মুরগীর জাত তৈরী করেছে, তা কোন ইশ্বরের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিকল্পনা ছিলো না, ছিলো মানুষের। তবে মানুষকে এত ক্রেডিট দেওয়ারও কিছু নেই, তারা এমন কোন নতুন বৈশিষ্ট্য যোগ করতে পারতো না যা বন্য মুরগীর জেনেটিক পুলে নেই। একদিক দিয়ে দেখলে, মুরগী ও মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক ছিলো অন্য মিথজীবী সম্পর্কের মতই, যেমনটা মৌমাছি উজ্জ্বল রঙ্গিন ফুল নির্বাচন করে পরাগায়ন করে বংশ বৃদ্ধি করে থাকে। চার বিলিয়ন বছরের প্রাকৃতিক নির্বাচনের পর, একটি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারড প্রাণী একটি নতুন মহাজাগতিক কালের শুরুতে দাঁড়িয়ে, যে সময় বুদ্ধিবৃত্তিক পরিকল্পনার দ্বারা জীবন শাসিত হবে। তাই যদি ঘটে, তাহলে পিছনের দিকে তাকালে ইতিহাসের ওই সময় পর্যন্ত পুরো সময়কেই এক ধরনের পরীক্ষা নীরিক্ষা ও মানুষের অদক্ষ হাতের কাজ হিসেবে বর্ণনা করতে হবে। ত্রিশ হাজার বছর আগে স্টেইডেলের গুহায় মানুষ যে সিংহ মানবকে কল্পনা করে মূর্তি আঁকতো, আজ মানুষ আসলেই এইসব কাল্পনিক জীব সৃষ্টি করতে সক্ষম।

 তবে ধার্মিক একেশ্বরবাদীরা ছাড়াও আরো অনেকে আপত্তি করেছিলো যে ইশ্বরের ভূমিকায় মানুষের হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। ফ্র‍্যাঙ্কেনষ্টাইনের প্রফেসি বলে, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে হয়তো কোন অতিমানব তৈরী করা হবে আর সে আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এটি আমাদের সতর্ক করে যদি আমরা ইশ্বরের ভূমিকা পালন করার চেষ্টা করি তবে আমাদের কঠিন শাস্তি পেতে হবে। এইজন্য, বর্তমান সময়ে বেশিরভাগ জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করা হয় গাছপালা, ছত্রাক, ব্যাক্টেরিয়া ও পোকামাকড়ের উপর, যেগুলির উপর তেমন রাজনৈতিক প্রভাব নেই। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে বুদ্ধিমান ইদুরের মত বুদ্ধিমান মানুষ তৈরী করাও যদি সম্ভব হয়, দ্বিতীয় বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব ঘটে যাবে। সেই দিন হয়তো খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে আমাদের নৈতিকতা ও মূল্যবোধও নিয়ন্ত্রণ করা হবে সমাজ কাঠামো স্থিতিশীল রাখতে, তখন কি আমরা স্বকীয়তা হারাবো না? হোমো সেপিয়েন্স নিয়ে এত পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে করতে আমরা হয়ত আর হোমো সেপিয়েন্সই থাকবো না।


জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর উদ্দেশ্য শুধু জীবিত প্রাণীর বংশগতিই পরিবর্তন করা নয়, বিলুপ্ত প্রাণীদেরও পুনরুজ্জীবিত করা। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা ম্যামথের জিনোম ম্যাপ করে হাতির ফার্টিলাইজড এগ সেলে ম্যামথের DNA রিপ্লেস করে নতুন ম্যামথ জন্ম দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন বিলুপ্তির ৫০০০ বছর পর। একইভাবে কি নিয়েন্ডের্থালদের প্রত্যাবর্তন করা যাবে? কেউ কেউ যুক্তি দেন, হোমো সেপিয়েন্সরা যদি নিয়েন্ডের্থালদের বিলুপ্তির জন্য দায়ী হয়, তবে তাদের পুনরুজ্জীবিত করা নৈতিক দায়িত্ব।

 আজ দুর্ঘটনায় যারা হাত পা হারায়, তাদের জন্য বায়োনিক বা রোবোটিক হাত পা স্থাপন করা হয়। বর্তমানে এগুলো আসল হাতের তুলনায় দুর্বল প্রপ্তিস্থাপন, কিন্তু ভবিষ্যতে এর উন্নতির সম্ভাবনা সীমাহীন। ভবিষ্যতে হয়তো বায়োনিক হাত প্রকৃত হাতের চেয়েও অনেক শক্তিশালী করে তৈরী করা যেতে পারে, এমনকি বক্সিং চ্যাম্পিয়নকেও তখন দুর্বল মনে হবে। কিংবা ধরুন কি ঘটতো, যদি আলঝেইমার রোগের এমন একটি নিরাময় আবিষ্কৃত হতো যার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া মানুষের শক্তি নাটকীয়ভাবে অধিকতর উন্নত করতো? তখন কি পুলিশ এর ব্যবহার রোগীর মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখতো? নাকি সবাই স্মৃতিশক্তির কম্পিটিশানে নেমে পড়তো? মনে করুন, আপনার স্মৃতি ভবিষ্যতে কপি করে হার্ডডিস্কে বা পেনড্রাইভে রাখা যায়। তখন যদি কেউ সেই স্মৃতি ডিলিট করে দেয়, আপনি কি তার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনতে পারবেন? আজ যদি বিভিন্ন মস্তিষ্ককে একটি অপরটির সাথে যুক্ত করে, একটি ইন্টার-ব্রেইন-নেট তৈরী করা হয়? তখন এটি মূলত অন্য এক ধরনের সত্ত্বা হবে যেটা আমরা দর্শনগত, মানসিক বা রাজনৈতিক প্রভাবের দিক থেকে কল্পনা করতে পারি না। হয়তো আমাদের বিশ্বকে একটি অর্থ প্রদান করে এমন সব ধারণা, যেমন আমি, তুমি, পুরুষ, নারী, প্রেম, ঘৃণা সব অবান্তর হয়ে যাবে।

চিন্তা করুন কম্পিউটার ভাইরাসের কথা। এটি এমন একটি সফটওয়্যার যেটি নিজের লক্ষ লক্ষ প্রতিলিপি তৈরী করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে যায়। কখনো কখনো ভাইরাসটি হয়তো তার ভুল প্রতিলিপি তৈরী করে ফেলে, যেটাকে বলা যেতে পারে কম্পিউটারাইজড মিউটেশন। এভাবে যদি চলতে থাকে, সাইবার স্পেস নতুন ভাইরাসে পূর্ণ হয়ে যাবে, সব মিলিয়ে এটাকে বলা যেতে পারে নন অর্গানিক বিবর্তন। এখন পর্যন্ত আমাদের বিবর্তন হয়ে আসছে জৈবিক পর্যায়ে, তখন হয়তো বিবর্তন হবে সিলিকন চিপের তৈরী জগতে। ৪ বিলিয়ন বছর পর জৈব যৌগের ছোট পরিসর থেকে জীবন হঠাৎ অজৈব জগতে ছড়িয়ে পড়বে।

বীমা কোম্পানিগুলো হয়তো ভবিষ্যতে আমাদের DNA scan report চাবে এবং বেপরোয়া আচরণের জেনেটিক প্রবণতা থাকলে প্রিমিয়াম বৃদ্ধি করবে। চাকরির আবেদনে হয়তো CV এর বদলে DNA copy চাবে। একজন নিয়োগকর্তা কি কোন প্রার্থীর প্রতি ভালো DNA এর জন্য পক্ষপাত হবে? ধর্ম, অর্থ, বর্ণ ইত্যাদির পর কি নতুন মোড়কে 'জেনেটিক' বৈষম্য শুরু হবে? এটি ভালোই ছিলো যতদিন ঔষধের কাজ ছিলো রোগ নিরাময়, কি ঘটবে যদি মানুষ নিজের সক্ষমতা বাড়াতে ঔষধে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে? এটি কোন সায়েন্স ফিকশন নয়। নৈতিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নিয়ে মুখ্য প্লটগুলি আমাদের নিজেদের পৃথিবী থেকে নেয়া। আমাদের অতি অধুনা বিশ্বের দাবি হলো এটি ইতিহাসের প্রথমবারের মত সব মানুষের মৌলিক সমতাকে স্বীকৃতি দেয়, তবুও এই সময়টাতেই সম্ভবত সকল সমাজে সবচেয়ে বেশি অসমতা সৃষ্টি হয়েছে।

আসলে ভবিষ্যত বিশ্বের অধিপতি হিসেবে আমরা নিয়েন্ডার্থালদের তুলনায় যতটা ভিন্ন, বর্তমানের তুলনায় তার চেয়ে বেশি ভিন্ন হবো। পক্ষান্তরে আমরা আর নিয়েন্ডার্থাল উভয়ই মানবজাতি হলেও, আমাদের উত্তরাধিকার হবে দেবতুল্য। আমরা হয়তো বিগব্যাং এর মত নতুন সিঙ্গুলারিটির দিকে এগিয়ে চলেছি। আবার সবসময় যে আমরা ভবিষ্যতকে সম্পূর্ণভাবে কল্পনা করতে পেরেছি তাও নয়। স্পুটনিক ও এপলো ১১ উৎক্ষেপণের সময় মানুষ ধারণা করেছিলো মঙ্গল ও প্লুটোতে আবাস গড়ে তুলবে যা হয় নি। আবার ইন্টারনেটের কথা কেউ কল্পনাও করতে পারে নি।

যদি সত্যিই সেপিয়েন্সের যবনিকা পতন আসন্ন হয়ে থাকে, এর সর্বশেষ প্রজন্মের এক সদস্য হিসেবে একটি শেষ প্রশ্ন করার জন্য সময় ব্যয় করতে চাইঃ আমরা কেমন হতে চাই? কিন্তু যেহেতু আমরা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বা অন্য কোনভাবে আমরা ভবিষ্যতকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো, আমাদের প্রশ্ন হয়তো এই নয় যে, 'আমরা কি হতে চাই?' বরং আমাদের প্রশ্ন হতে পারে 'আমরা কি চাইতে পারি?'

     The Animal that Became a God

সত্তর হাজার বছর আগে হোমো স্যাপিয়েন্স তখনো একটি মামুলি প্রাণী হিসেবে আফ্রিকার এক কোণে নিজেদের খাদ্য সংগ্রহে ব্যস্ত ছিলো। পরবর্তী সহস্রাব্দে এটি সমগ্র গ্রহের অধিকর্তা এবং পরিবেশের হুমকি হিসেবে নিজেকে রূপান্তরিত করেছিলো। আজ এটি এক দেবতা হয়ে উঠার প্রান্তে এসে উপস্থিত হয়েছে, কেবল চির যৌবন অর্জনের জন্যই নয়, সৃষ্টি ও ধ্বংসের ঐশ্বরিক ক্ষমতাও অর্জনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।

দুর্ভাগ্যক্রমে, পৃথিবীতে সেপিয়েন্সের শাসন এখন পর্যন্ত গর্বিত হওয়ার মত সামান্য কিছুই করেছে। আমরা আমাদের আশপাশকে নিয়ন্ত্রণে এনেছি, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করেছি, শহর নির্মাণ করেছি, সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছি এবং দূরপাল্লার বাণিজ্য নেটওয়ার্ক তৈরী করেছি। কিন্তু আমরা কি পৃথিবীর দুঃখের পরিমাণ কমিয়েছি? সেপিয়েন্সের শক্তির ব্যাপক বৃদ্ধি তাদের জন্য তেমন মঙ্গলজনক হয় নি। অন্যান্য প্রাণীর অপরিসীম দুর্ভোগের কারণ হয়েছে। মানুষের অধিকাংশ উন্নতি হয়েছে অতি সম্প্রতি এবং এটি নিশ্চিত ভঙ্গুর।

উপরন্তু, মানুষের বিস্ময়কর সক্ষমতা সত্ত্বেও আমরা লক্ষ্য সম্পর্কে অনিশ্চিত এবং বরাবরের মতই অসন্তুষ্ট। আমরা আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী হয়েছি, কিন্তু এই শক্তি দিয়ে আমরা কি করবো সে সম্পর্কে সামান্যই ধারণা আছে। মানবজাতিকে এখন আগের তুলনায় দায়িত্বহীন বলে মনে হয়। আমরা সঙ্গী প্রাণী ও পরিবেশের উপর নিপীড়ন করি, আমরা নিজেদের জন্য আরেকটু স্বস্তি পেতে চাই। তবুও আমরা কখনোই সন্তুষ্টি খুঁজে পাই না।

অসন্তুষ্ট ও দায়িত্বহীন দেবতাদের চেয়ে মারাত্মক আর কিছু কি আছে, যারা জানে না তারা কি চায়?

(সমাপ্ত)


Popular Posts