Sapiens Synopsis E02: The Agricultural Revolution



History’s Biggest Fraud

Cognitive Revolution মাত্র ৭০ হাজার বছর আগের কথা। এর বহু আগে থেকেই অর্থাৎ ২৫ লক্ষ বছর আগে থেকে মানব সদস্যরা শিকার এবং সংগ্রহবৃত্তির মাধ্যমে নিজেদের অন্নের সংস্থান করতো। অন্যান্য মানব সদস্যরা বন্য ফল সংগ্রহ ও শিকার করলেও কখনো ভাবেনি কিভাবে ডুমুর জন্মাবে বা কিভাবে গৃহপালিত পশু প্রতিপালন ও প্রজনন করাবে। ১০ হাজার বছর আগে সেপিয়েন্স তাদের প্রায় সবটুকু সময় ও চেষ্টা ব্যয় করে প্রাণী ও উদ্ভিদের অল্প কিছু প্রজাতির উন্নয়নে নিজেদের নিয়োজিত রাখতে শুরু করে। সূচনা হয় Agricultural Revolution বা কৃষি বিপ্লবের।

মূলত এর শুরু হয় পশ্চিম ইরান, দক্ষিণ পূর্ব তুরস্ক এবং লেভান্তের পাহাড়ি অঞ্চলে। তবে কৃষি বিপ্লব মধ্যপ্রাচ্য থেকে ছড়িয়ে পরেনি, বরং ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে স্বাধীনভাবে কৃষিবিপ্লবের সূচনা হয়। কেন মধ্যপ্রাচ্যেই প্রথম কৃষিবিপ্লব হয়? কারণ সব প্রজাতি সব জায়গায় জন্মায় না, যেসব নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট প্রজাতি জন্মাতো, সেসব জায়গাতেই কৃষি বিপ্লব শুরু হয়েছে। গম উৎপাদন শুরু হয় ৯ হাজার BC, মটর ও মসুর ৮ হাজার BC, জলপাই ৫ হাজার BC, ঘোড়া ৪ হাজার BC এবং আঙ্গুর ৩৫০০ BC তে। তবে এর মাঝে আর তেমন কোন পরিবর্তন আসে নি, কোন উল্লেখযোগ্য প্রাণী বা উদ্ভিদ গত ২ হাজার বছরে domesticated করা হয় নি। আমাদের মন যদি হয় প্রাক- কৃষি যুগের শিকারী সংগ্রহকারীদের মত, রন্ধন প্রণালী তবে আদিম কৃষকদের মত।

কৃষিবিপ্লব নিশ্চিতভাবে মানব প্রজাতিগুলোর জন্য স্বস্তি এনেছে, কিন্তু উত্তম খাদ্য বা অবসর নিশ্চিত করে নি। বরঞ্চ, এটি জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে এবং অভিজাত বর্গের জন্ম দিয়েছে। সাধারণ শিকারী সংগ্রহকারীদের চেয়ে গড়ে সাধারণ কৃষকরা অত্যাধিক কঠোর পরিশ্রম করতো, বিনিময়ে নিম্নমানের খাবার লাভ করতো। কৃষিবিপ্লব হলো ইতিহাসের সবচেয়ে বড় প্রতারণা। এই প্রতারণার জন্য কারা দায়ী? না, কোন রাজা, ধর্মীয় নেতা, ব্যবসায়ী না। এরজন্য দায়ী গম। হ্যা বুদ্ধিহীন সামান্য এক ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ দায়ী। গম তার নিজের সুবিধার জন্য Homo sapiens কে নিপুণভাবে ব্যবহার করেছে।

গম পাথুরে ভূমি আর নুড়ির মাঝে ভালো জন্মায় না, তাই সেপিয়েন্স গমের জন্য আশপাশের স্থান পরিষ্কার করা শুরু করলো। গম তার পুষ্টি অন্য প্রাণীদের সাথে ভাগ করতে চায় না, তাই নারী পুরুষদের আগাছা পরিষ্কার করতে হতো। গম নানা রোগে আক্রান্ত হতো, নানা প্রাণী আক্রমণ করতে আসতো, তাই কৃষকদের প্রতিরক্ষার প্রতি নজর দিতে হতো। গম চাষে প্রচুর পানি প্রয়োজন হতো, এইজন্যও মানুষ প্রচুর খেটেছে। কিন্তু এই ধরনের কাজের জন্য সেপিয়েন্স ওই সময়ে বিবর্তিত হয় নি, তারা বিবর্তিত হয়েছিলো ফল আহরণ এবং শিকার করার উপযোগী হয়ে। এজন্য আমাদের মূল্য শোধ করতে হয়েছে মেরুদণ্ড, হাঁটু, পাঁজর, ঘাড় দিয়ে। মানুষ গমের যত্ন নিতে গিয়ে ক্ষেতের কাছেই স্থায়ী বসতি গড়েছিলো, তাদের অবস্থান অনড় হয়ে গেলো। শিশু মৃত্যুহার বেড়ে যায় খাদ্যের জন্য প্রতিযোগিতায়, তাকে ছাপিয়ে বৃদ্ধি পায় জন্মহার, ঘটে জনবিস্ফোরণ। ঘনবসতি স্থাপনের জন্য আমাদের মাঝে দেখা গেলো মহামারী৷ রীতিমত আমরা গমের দাস হয়ে গেলাম, আমরা গমকে ডমিস্টিকেটেড করি নি, গম আমাদের ডমিস্টিকেটেড করেছে। আমাদেরকে ব্যবহার করে গমের কি লাভ হলো? আগে গম ছিলো মধ্যপ্রাচ্যের সীমিত পরিসরের এক বুনো ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ, আর এখন গম সারা পৃথিবীতে ব্যাপক হারে উৎপন্ন হয়৷

বিনিময়ে গম আমাদের কি দিয়েছে? উত্তম খাদ্যের প্রতিশ্রুতি তো দেয় নি, এর থেকে কৃষকদের পূর্বসূরি যাযাবরদের খাদ্য তালিকা আরো সুষম ছিলো। অর্থনৈতিক নিরাপত্তাও দেয় নি৷ শিকারী সংগ্রহকারীদের একাধিক খাদ্য উৎস থাকায় মজুত খাদ্যের উপর নির্ভর করতে হতো না বৈরী আবহাওয়াতেও৷ অথচ বৃষ্টি না হলে বা পঙ্গপালের আক্রমণ হলেই লক্ষ লক্ষ কৃষক মারা যেত। কৃষিবিপ্লব আমাদের নৈতিকভাবেও সভ্য করে নি, ভূমি নিয়ে হানাহানি পূর্বপুরুষ যাযাবরদের মতই সহিংস ছিলো। শত্রুর আক্রমণে যাযাবররা সরে যেতে পারলেও ক্ষেত ছেড়ে কৃষকরা সরে যেতে পারতো না, নয়তো বাড়িঘর ও শস্যাগারের অধিকার ছেড়ে পলায়ন করতে হতো।

কৃষি সমাজগুলোতে গ্রাম ও গোত্রের বাইরে কোন রাজনৈতিক অবকাঠামো ছিলো না।১৫ শতাংশ মৃত্যুর জন্য মানব সহিংসতা দায়ী ছিলো। কৃষি বিপ্লব আমাদেএ অবশ্যই কিছু সুবিধা দিয়েছিলো, যেমন বন্য প্রাণী, বৃষ্টি ও ঠান্ডা হতে সুরক্ষা। কিন্তু সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি। যেহেতু আমরা বৈভব এবং নিরাপত্তা ভোগ করছি, আর যেহেতু কৃষিবিপ্লব আমাদের এই বৈভব আর নিরাপত্তার ভিত্তি, আমরা ধরে নিই কৃষি বিপ্লব ছিলো এক বিস্ময়কর উন্নতি। কিন্তু ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি ভুল ছিলো। মানুষ কেন এমন ভুল করলো? কারণ মানুষ মনে করেছিলো কঠোর পরিশ্রম করলে অধিক ফসল ফলবে, কিন্তু এটা আর খেয়াল করে নি সন্তানের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। গোড়ার দিকের কৃষক কেউ বুঝে নি বেশি জাউ এবং কম দুধ তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেবে। কিন্তু পরিকল্পনা যখন উল্টো বিপর্যয় ঘটালো কেন তারা যাযাবরের জীবনে ফিরে এলো না? কারণ ততদিনে কৃষকসমাজ যাযাবর জীবনযাপন ভুলে গিয়েছিলো, ওই জীবনের দক্ষতা নিপুণতা আর তাদের মাঝে ছিলো না।

 কৃষিবিপ্লব জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সমগ্র হোমো স্যাপিয়েন্সকে জাতিগতভাবে সুরক্ষিত করেছিলো৷ ব্যক্তি পর্যায়ে কৃষকদের জীবনের মান যাযাবরদের থেকে নিম্নমানের করে দিলেও, জনসংখ্যার বিস্ফোরণ মোটা দাগে হোমো স্যাপিয়েন্সের বিলুপ্তির সম্ভাবনা নাকচ করে দেয়। বিবর্তনের চালিকা শক্তি জীবনের মান যা সুখ নয়, বরং DNA helix এর প্রতিলিপি। একটি কোম্পানির অর্থনৈতিক সাফল্য পরিমাপ করা হয় ব্যাংক একাউন্ট এর ডলার দিয়ে, কর্মচারীর সুখ দিয়ে নয়৷ তেমনি প্রজাতির বিবর্তনের সাফল্যও পরিমাপ করা হয় সদস্যসংখ্যা দ্বারা, তার জীবনমান দিয়ে নয়৷ এটিই কৃষি বিপ্লবের সারকথা, খারাপ পরিস্থিতে অধিক সংখ্যক মানুষ বাঁচিয়ে রাখার যোগ্যতা৷ কেবল হোমো সেপিয়েন্সের জিনোমের প্রতিলিপি সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য কেন মানসিকভাবে সুস্থ একজন ব্যক্তি তার জীবনযাত্রার মান কমাবে? কৃষিবিপ্লব ছিলো একটি ফাঁদ।

 ইতিহাসের একটি নিয়ম হলো বিলাসিতা একসময় অপরিহার্য হয়ে পরে এবং নতুন বাধ্যবাধকতার জন্ম দেয়। যেমন ডাকযোগে চিঠি পাঠানোর পরিবর্তে মেইল পাঠাতে আমাদের সময় কম লাগলেও ব্যক্তিগত সময় বাচে নি, এখন দিনে এক ডজন মানুষ আমাদের মেইলের দ্রুত উত্তর আশা করে। '৯০ এর আমলে ফোন বিলাসিতা হলেও বর্তমান সময়ে এসে ফোন ছাড়া অনেকের জন্য জীবনযাপন সম্ভব না। বিলাসিতার ফাঁদ আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়, একটি সহজ জীবনের প্রত্যাশায় মানুষ এমনভাবে বিশ্বকে পরিবর্তন করে ফেলে যা কেউ কল্পনা করে নি বা চায় নি৷

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ খাদ্য সংকট বা জনসংখ্যার চাপ ছিলো না৷ আধুনিক কালে যুদ্ধ ও বিল্পবের কারণ খাদ্য সংকট নয়৷ ক্ষুধাকাতর চাষী নয়, ধনাঢ্য আইনজীবীরাই ফরাসি বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছিলো। ১৯৯১ সালে যুগোস্লাভিয়া বিভক্ত হয়ে ভয়ানক রক্তপাতে জড়িয়ে পরেছিলো ক্ষুধার জন্য নয়৷  কিন্তু এটা প্রমাণ করা কঠিন যে প্রিলিটারেট মানুষরা অর্থনৈতিক প্রয়োজনের পরিবর্তে বিশ্বাস দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলো। তবে কিছু বিরল ক্ষেত্রে আমরা কিছু প্রমাণ পেয়েছি। দক্ষিণ পূর্ব তুরস্কে গোবেকলি টেপিতে ৯৫০০ BC এর কিছু স্তম্ভ পাওয়া যায় যার একটির ভর ৫০ টন পর্যন্ত। খাদ্য সন্ধানে ঘুরে বেড়ানো সমাজ কেন এই ধরনের কাঠামো নির্মাণ করেছিলো? কারণ যাই ছিলো না কেন, যাযাবররা এটিকে ব্যাপক চেষ্টা ও সময় ব্যয় করার মত মূল্যবান মনে করেছিলো। কেবল একটি উন্নত ধর্মীয় বা মতাদর্শগত পদ্ধতি এই ধরনের প্রচেষ্টায় শক্তি যোগাতে পারে। গোবেকলি টেপি ইঙ্গিত দেয় হয়তো প্রথমে মন্দির তৈরী করেছিলো এবং এর চারপাশ ঘিরে গ্রামটি গড়ে উঠেছিলো।

 

মানুষ যখন পশুপালন শুরু করলো, আক্রমনাত্মক ভেড়াকে হত্যা করতো আর মোটা আজ্ঞাবহ ভেড়ার অধিক যত্ন নিতো। তাই ভেড়ারা নিজেদের স্বার্থে মোটা, আরো আজ্ঞাবহ, কম কৌতুহলী হয়ে বিবর্তিত হতে থাকলো। দুর্ভাগ্যবশত, বিবর্তনীয় দৃষ্টিকোণ হল সাফল্যের একটি অসম্পূর্ণ পরিমাপ। এটি বেঁচে থাকা ও প্রজননের মানদন্ড দিয়ে সবকিছুকে বিচার করে। কোন ব্যক্তিগত কষ্ট ও সুখ বিবেচনা না করে। যেমন আগে বন্যমুরগি ৭-১২ বছর বাচতো, স্বাধীন জীবনযাপন করতো। পৃথিবীতে এখন ২৫ হাজার কোটি মুরগী আছে অর্থাৎ বিবর্তন এদেরকে বিলুপ্তির ভয় থেকে অনেক দূরে রেখেছে কিন্তু এদের আয়ু হয়ে গেছে ৩ মাস, কারণ ৩ মাসে মুরগীর শারীরিক গঠন সর্বোচ্চ হলে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ একে আর বাচিয়ে রাখার কারণ নেই৷ উপরন্তু এরা আগে যেখানে মুক্ত পরিবেশে বিচরণ করতো, এখন তারা এত ক্ষুদ্র খাচায় থাকে যে পাখাটাও মেলার উপায় নাই।

অধিকাংশ গবাদি পশুর জন্য কৃষিবিপ্লব ছিলো ভয়ানক বিপর্যয়। প্রাণী বশে আনার জন্য পুরুষের খোজাকরণ সাধারণ ঘটনা। নিউ গিনিতে শুকরের মালিক শুকরের একটুখানি নাক কেটে রাখতো যাতে তারা গন্ধ শুঁকতে গেলে প্রচন্ড ব্যাথা পায় এবং গন্ধ শুঁকে শুঁকে পালানোর পথ না পায়। গাভীর দুধ আর বাছুরের অধিকারে নেই, এটা এখন আমাদের অধিকার। সাহারায় উট প্রজননকারীরা নাকের ও ঠোঁটের উপরের অংশ কেটে রাখতো যাতে দুধ পান করতে উটের বাচ্চার কষ্ট হয়। কিছু পশুপালক দুধ দোয়ানোর সময় বাছুরকে সামনে রখে যাতে গাভী দুধ উৎপাদনে বাছুরকে দেখে উৎসাহিত হয়। তবে কিছু গৃহপালিত পশুর জীবন উন্নত হয়। উলের জন্য পালন করা ভেড়া, যুদ্ধ ও রেসের ঘোড়া এরা উন্নত আরামদায়ক জীবনই পেত।

মোটের উপর শেষপর্যন্ত যা দাঁড়ালো, বিবর্তনীয় ভাষায়, সবচেয়ে সফলভাবে টিকে থাকা প্রাণীগুলোই হলো সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্ত প্রাণী৷

 

Building Pyramids

কৃষি বিপ্লবের সময় মানুষ বসবাস করতো স্থলভাগের মাত্র ২% অঞ্চল নিয়ে৷ এক একটা গোত্র কৃত্রিম দ্বীপ বা ছিটমহলের মত বিচ্ছিন্নভাবে ছিলো এবং সেটা ত্যাগ করে চলে যাওয়া কঠিন ছিলো। আদিম শিকারী সংগ্রহকারীরা দূর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতো না, তারা প্রতিনিয়ত খাবার সংগ্রহে মনযোগ দিত। তবে তাদের আলতামিরা গুহাচিত্রে, সামাজিক সংহতি, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এগুলো ছিলো দীর্ঘমেয়াদী বিষয়। তবুও তাদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা সীমাবদ্ধ ছিলো৷ অন্যদিকে কৃষি বিপ্লবের পর কৃষক সমাজ দূর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতো, খাদ্য মজুত করতো। অন্য প্রাণীদের থেকে আমাদের এগিয়ে থাকার অন্যতম কারণ হলো আমরা একে অপরকে যেই পর্যায়ে সহযোগিতা বা 'কো অপারেশন' করতে পারি এত গভীরভাবে অন্য কোন প্রাণী পারে না। কিন্তু এই 'কো-অপারেশন' পরোপকারী শোনালেও এটা আসলে স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত এবং কদাচিৎ সমাধিকারভিত্তিক হয়। বরং অধিকাংশ হিউম্যান কো-অপারেশন নেটওয়ার্ক নিপীড়ন ও শোষণের দিকে ধাবিত হয়েছে৷

মিথ এর কার্যকরিতা বর্ণনা করতে এর আগে Peueot এর প্রসঙ্গ টানা হয়েছিলো। এমন আরো কিছু ইতিহাসের বিখ্যাত মিথ হলো ১৭৭৬ BC এর হাম্মুরাবির কোড, ১৭৭৬ AD এর আমেরিকান ঘোষণাপত্র৷ ১৭৭৬ BC তে ব্যাবিলন ছিলো বিশ্বের বৃহত্তম শহর। এটি মেসোপটিমিয়ার অধিকাংশ অংশ শাসন করেছে। ব্যাবিলনের তৎকালীন রাজা ছিলেন হাম্মুরাবি। Code of Hammurabi শুরু হয় এভাবে-

দেবদূত আনু, এনলিল, মার্দুক, মেসোপটিমিয়ার সর্বদেবতার মন্দিরের নেতৃস্থানীয় দেবতারা - হাম্মুরাবিকে নিযুক্ত করেছেন ভূমিতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতিবাজ ও মন্দকে বিলুপ্ত ও সবলের অত্যাচার থেকে রক্ষা করার জন্য। এতে ৩০০ রায় তালিকাভুক্ত হয়।

হাম্মুরাবির কোড বা আইন অভিজাত, সাধারণ ব্যক্তি ও ক্রীতদাসের জন্য ভিন্ন ছিলো। কোন অভিজাত ব্যক্তি অন্য অভিজাত ব্যক্তিকে অন্ধ করে দিলে তাকেও অন্ধ করে দেওয়া হতো, কিন্তু কোন সাধারণ ব্যক্তিকে হত্যা করলে শুধু ৬০ শিকল ওজনের সমান রৌপ্য জরিমানা করা হতো। নারীদের জন্যও আইন ছিলো বৈষম্যমূলক। ক্রীতদাসী নারীকে আঘাত করলে মাত্র ২ শিকল ওজনের সমান রৌপ্য জরিমানা করা হতো। এবং এই আইন অনুযায়ী নির্দোষ ব্যক্তিও শাস্তি পেতো৷ যেমন অভিজাত ব্যক্তি কোন নারীকে হত্যা করলে ওই অভিজাত ব্যক্তির কন্যাকে হত্যা করার আইন ছিলো। শিশুদের স্বাধীন ব্যক্তি বিবেচনা করা হতো না, পিতা মাতার সম্পত্তি মনে করা হতো। কিন্তু ব্যবিলনীয়দের কাছে ওই সময় ওই আইন সঠিক বলেই বিবেচিত হতো৷

 এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়, হাম্বুরাবি কখনো বলেননি যে কোডটা তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন। বরং বলেছেন দেবতারা উনাকে নির্বাচিত করেছেন। এভাবে মিথের সৃষ্টি হয় যার উপর ভিত্তি করে ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য দশ হাজার বছর শাসন করেছে। অবশ্য, ১৭৭৬ সালে আমেরিকার ইশ্বর নির্দেশিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতি ছিলো ব্যবিলনের দেবতাদের নির্দেশিত নীতি থেকে কিছুটা ভিন্নঃ

We hold these truths to be self-evident, that all men are created equal, they are endowed by their Creator with certain unalienable rights, that among these are life, liberty and the pursuit of happiness.

 হাম্মুরাবির কোড এবং আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র উভয়ই ন্যয়বিচারের সার্বজনীন এবং শাশ্বত রূপরেখা দাবি করে, তবে আমেরিকার ঘোষণা অনুযায়ী সব মানুষ সমান এবং ব্যাবিলনীয় কোড অনুযায়ী সব মানুষ সমান না। হাম্মুরাবিরা টিকে থাকলে মনে করতো যে আমেরিকানরা ভুল আর আমেরিকানরা মনে করে হাম্মুরাবিরা ভুল। আসলে তারা উভয়েই ভুল। কারণ সকল মানুষ সমান এটাও একটা মিথ। সব মানুষ অবশ্যই সমানভাবে 'বিবর্তিত' হয় নি, কারণ বিবর্তন একটি র‍্যান্ডম ঘটনা। আমেরিকানরা খ্রীষ্টবাদ থেকে সমতার ধারণা পেয়েছে৷ কিন্তু বাস্তবে প্রতিটা মানুষ কিছুটা ভিন্ন জেনেটিক কোড বহন করে। তাই "created equal" কে "ভিন্নভাবে বিবর্তিত বলা উচিত। " endowed by their creator" কে "জন্মগ্রহণ" হিসেবে অনুবাদ করা উচিত। " unalienable right" বলেও কিছু নেই, পাখি এই জন্য উড়ে না যে তাদের উড়ার অধিকার আছে, বরং উড়ে কারণ তাদের পাখা আছে যেটা তাদের পরিবর্তিত বৈশিষ্ট্য। আর জীববিজ্ঞানের ভাষায় 'liberty' বলে কিছু নেই, জীববিজ্ঞান সুখের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ। সুতরাং আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জীববিজ্ঞানের ভাষায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়-

We hold these truths to be self-evident, that all men evolved differently, that they are born with certain mutable characteristics and that among these are life and pursuit of pleasure.

বাস্তবতা হলো, আমরা সবাই জানি মানুষ জৈবিকভাবে সমান নয়, কিন্তু আমরা যদি বিশ্বাস করি যে আমরা সকলে সমতুল্য, তাহলে স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবো৷ আমরা একটি নির্দিষ্ট 'নিয়মে' বিশ্বাস করি এই কারণে নয় যে এটি বস্তুনিষ্ঠভাবে সত্য, তবে এই কারণে যে এর প্রতি বিশ্বাস কার্যকরভাবে সহযোগিতা করতে এবং একটি উন্নত সমাজ বিকশিত করতে আমাদের সক্ষম হবে। হাম্মুরাবিও একই যুক্তি ব্যবহার করে তার পদানুক্রম আইনসমূহ রক্ষা করবে, 'আমি জানি যে অভিজাত,সাধারণ এবং ক্রীতদাসরা জন্মসূত্রে ভিন্ন ভিন্ন মানুষ নয়, কিন্তু আমরা যদি বিশ্বাস করি যে তারা সেটাই, এটি আমাদের স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ সমাজ তৈরী করতে সক্ষম করবে।

ভলতেয়ার বলেছিলেন, "There is no God, but don't tell that to my servant, lest he murder me at night." হাম্বুরাবি এবং টম জেফারসনও তাঁর মানবাধিকারের মিথ নিয়ে একই ধারণা পোষণ করতেন৷ Homo sapiens দেরও প্রকৃতি প্রদত্ত কোন অধিকার নেই, যেমন মাকড়সা, হায়েনা বা শিম্পাঞ্জিদেরও নেই, কিন্তু একটি সুশৃঙ্খল সমাজ ব্যবস্থার খাতিরে তা সবার জানারও দরকার নেই৷

একটি কল্পিত নিয়ম পতনের সম্ভাবনা থাকে, কারণ মিথ বিলুপ্ত হয়ে যায় যখন তা কেউ আর বিশ্বাস না করে। আর্মি, পুলিশ বাহিনী, আদালত, কারাগারগুলি অবিরামভাবে কাজ করছে যাতে মানুষ কল্পনাপ্রসূত নিয়ম অনুযায়ী আচরণ করে। ১৮৬০ সালে মার্কিন নাগরিকরা যখন বিশ্বাস করলো ক্রীতদাসদের অধিকার ও স্বাধীনতা মানুষের সমান, দক্ষিণের রাজ্যগুলোকে তা মানাতে রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ হয়েছিলো। লক্ষ সৈন্যের সামরিক নিয়ম বজায় থাকে কারণ তারা অন্তত কোন একটি মিথে বিশ্বাস করে - হোক ইশ্বর, সম্মান, মাতৃভূমি, পুরুষত্ব বা অর্থ। আরো একটি কৌতুহলউদ্দীপক প্রশ্ন সামাজিক পিরামিডের উপর দাঁড়িয়ে আছে৷ মানুষ কেন একটি কল্পনাপ্রসূত নিয়মের উপর জোর দেয় যদি তারা সেটি বিশ্বাসই না করে। অভিজাতরা না হয় লোভের জন্য মিথে বিশ্বাস করে কিন্তু cynic রা যারা কোন কিছুই বিশ্বাস করে না? সিনিক্যাল স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ডায়োজেনেস একটি ব্যারেলের মাঝে বাস করতেন৷ আজেকজান্ডার দ্য গ্রেট একবার ডায়োজেনেসের সাথে সাক্ষাত করতে গিয়েছিলেন, তখন তিনি রোদ পোহাচ্ছিলেন৷ আলেকজান্ডার জিজ্ঞেস করলেন, "আমি কি আপনার জন্য কিছু করতে পারি?" Cynical ডায়োজেনেস ম্যাকেডোনিয়া থেকে ইজিপ্ট, গ্রিস থেকে ইন্ডিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত সাম্রাজ্যের অধিকারীকে বললেন,"হ্যাঁ আপনি আমার জন্য কিছু করতে পারেন৷ দয়া করে সামান্য সরে দাঁড়ান, আপনি সূর্যালোককে আড়াল করছেন।" এইজন্যই হতাশাবাদী বা cynical রা সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে পারেন না। অন্যদিকে, খ্রিষ্টধর্ম দুই হাজার বছর টিকে থাকতে ব্যর্থ হতো যদি অধিকাংশ বিশপ ও যাজক খ্রিষ্টে বিশ্বাস করতে ব্যর্থ হতেন। আমেরিকার গণতন্ত্র ২৫০ বছর টিকে থাকতে ব্যর্থ হতো যদি অধিকাংশ প্রেসিডেন্ট ও কংগ্রেসম্যান মানবাধিকারে বিশ্বাস করতে ব্যর্থ হতো। আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা একদিনও টিকতো না যদি অধিকাংশ বিনিয়োগকারী এবং ব্যাংকার পুঁজিবাদে বিশ্বাস করতে ব্যর্থ হতেন৷

 মিথ বিশ্বাসের প্রথম নিয়ম হলো স্বীকার না করা যে নিয়মটি কল্পিত। মানুষরা এই জন্য বিভাজিত নয় যে হাম্মুরাবি বলেছেন, বরং এইজন্য যে দেবতা এনলিল এবং মার্দুক এটাকে আইন হিসেবে বিধিবদ্ধ করেছেন। মানুষ এইজন্য সমান নয় যে টম জেফারসন বলেছেন, বরং এইজন্য সমান যে ইশ্বর তাদের ওইভাবেই সৃষ্টি করেছেন। মানুষের মিথের বিশ্বাস তাদের সাহিত্য, শিল্প, দৈনন্দিন জীবনেও লক্ষণীয়। বর্তমান মানুষ সমতায় বিশ্বাসী, তাই ধনীদের পুত্র যে ফ্যাশনেবল জিন্স পরে, সেটা আসলে ছিলো শ্রমিক শ্রেণীদের পরিচ্ছদ৷ মধ্যযুগের মানুষ শ্রেণি বিভাজনে বিশ্বাস করতো, তাই তারা কৃষকের কুচি দেওয়া ঢিলা কাপড় পরতো না৷ তিনটি কারণে মানুষ এই বিশ্বাস থেকে বিরত থাকে যে নিয়ম তাদের জীবনকে সংগঠিত করে তা অলীকঃ

১. কল্পিত নিয়ম বাস্তব বিশ্বে অন্তর্নিহিতঃ পাশ্চাত্যে বেশিরভাগ মানুষ আজ ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী, সন্তানরা ব্যক্তিগত কক্ষ পায় বাসায়৷ কিন্তু মধ্যযুগে অভিজাত সন্তানেরা ব্যক্তিগত কক্ষ পেত না, অন্য আরো তরুণদের সাথে ঘুমাতে হতো এবং সর্বদা নিজের ব্যক্তিত্ব বজায় রাখতে হতো৷ এই দুই চিন্তার পার্থক্যের ছাপ তাদের বাস্তব জীবনেও বিদ্যমান।

২. কল্পিত নিয়ম আমাদের ইচ্ছেগুলোকে আকৃতি দেয়ঃ ভোগবাদ আমাদের বুঝায় সুখী হতে হলে যতটা সম্ভব পণ্য ও সেবা ভোগ করতে হবে। প্রতিটি টিভি কমার্শিয়াল হলো কিভাবে তাদের পণ্য ভোগ করে জীবন উন্নত হয় তার লিজেন্ড। আবার পর্যটন শিল্প বিমানের টিকিট বা হোটেল কক্ষ বিক্রি করে না। এটি বিক্রি করে অভিজ্ঞতা। এখন একজন মিলিওনিয়ার এবং তার স্ত্রীর সম্পর্কের টানাপোড়ন চললে স্ত্রীকে নিয়ে প্যারিস ঘুরতে যান। কিন্তু প্রাচীনকালে মিশরের ধনী ব্যাক্তি সেটা চিন্তা করতেন না, বরং তার স্ত্রীর জন্য পিরামিড ব্যয়বহুল সমাধি বানাতেন, যেটা তার স্ত্রী সর্বদা চাইতেন।

 ৩. কল্পিত নিয়ম হলো ইন্টার সাবকেক্টিভঃ অবজেক্টিভ মানে যা আমাদের চেতনা ও বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে না। যেমনঃ তেজস্ক্রিয়তা বিশ্বাস না করলেও এর সংস্পর্শে আসলে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা আছে৷ সাবকেক্টিভ মানে যা আমাদের চেতনা ও বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে। যেমনঃ শিশু ছোটবেলায় পুতুলের সাথে কথা বলে, বড় হয়ে গেলে আর বলে না। আর ইন্টার সাবজেক্টিভ হলো যেই বিষয় অসংখ্য মানুষের কল্পনার উপর নির্ভর করে। যেমনঃ সবাই ক্রিশ্চান ধর্মে বিশ্বাস হারালে ক্রিশ্চান ধর্ম বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু Peugeot এর CEO একা Peugeot কে বিশ্বাস না করলে তাকে কেউ মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করে দিবে। কল্পিত নিয়ম ইন্টার সাবজেক্টিভ তাই মানুষ প্রভাবিত হয়ে এই চিন্তা থেকে দূরে সরে যায় যে কল্পিত নিয়ম আসলে শুধু কল্পনায় বিরাজ করে।


কল্পিত নিয়ম থেকে বের হওয়ার কোন উপায় নেই। যখন আমরা কারাগারের দেয়াল ভেঙ্গে ফেলি এবং মুক্তির দিকে এগিয়ে যাই, আমরা আসলে আরো বড় একটি কারাগারের আরো প্রশস্ত দেওয়ালের দিকে এগিয়ে যাই।

  

 Memory Overload

 

কিছু বৃহৎ প্রজাতির সমাজ স্থিতিশীল, প্রাণবন্ত, যেমন পিঁপড়া ও মৌমাছি। কারণ তাদেরকে স্থিতিশীল রাখার জন্য সর্বাধিক প্রয়োজনীয় তথ্য জিনোমে এনকোড করা রয়েছে। মৌচাকের সামাজিক কাঠামো অত্যন্ত জটিল, বিভিন্ন কর্মী, শিশু পালনকারী ও পরিস্কার কর্মী নিয়ে এটি গঠিত হয়৷ কিন্তু গবেষকরা কোন আইনজীবী মৌমাছি পান নি। কারণ রাণী মৌমাছি ক্লিনার মৌমাছিকে খাবারে ঠকায় না এবং তারা কখনো রাণী মৌমাছির উপরে হরতাল ডেকে আনে না। কিন্তু সেপিয়েন্সের সামাজিক বিধি মৌমাছিদের মত নয়। আমাদের সামাজিক বিধি কল্পিত, জিনোমের মাধ্যমে বংশধরের মাঝে এটি হস্তান্তর হয় না। হাম্মুরাবির কোড পরবর্তী প্রজন্মে জিনোমের মাধ্যমে হস্তান্তর হয় নি, বরং পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে শিখনের মাধ্যমে হয়েছে।

একটি সাম্রাজ্য বিপুল পরিমাণ তথ্য জেনারেট করে। কিন্তু মানব মস্তিষ্ক তিনটি কারণে তেমন ভালো ষ্টোরেজ ডিভাইস নয়। প্রথমত এর ধারণ ক্ষমতা সীমিত, দ্বিতীয়ত মানুষ মারা যায়, এবং তৃতীয়ত মানব মস্তিষ্ক অভিযোজিত হয়েছে কেবল নির্দিষ্ট তথ্য সংরক্ষণের জন্য৷ কিন্তু কৃষি বিপ্লবের পর নতুন ধরণের তথ্য প্রয়োজনীয় হয়ে উঠলো, সেটা হলো সংখ্যা। ৩৫০০ BC - ৩০০০ BC এর মাঝে সুমেরীয়রা লিখন পদ্ধতি উদ্ভাবন করে৷ কিন্তু মাটির ট্যাবলেটে লিপিবদ্ধ করা কঠিন কাজ ছিলো, তাই কেউ তখন রোমান্টিক উপন্যাস লিখত না, অতি প্রয়োজনীয় সংখ্যা ও হিসাব শুধু লিখে রাখতো। তাই আমাদের সর্বপ্রথম লিখিত ইতিহাসে কোন ফিলোসফিক্যাল ইনসাইট নেই, নেই কবিতা, কিংবদন্তী, আইন- ছিলো শুধু নীরস অর্থনৈতিক নথি। অন্যদিকে সুমেরীয় লিপি ছিলো আধুনিক গাণিতিক প্রতীক ও সঙ্গীত স্বরলিপির মতই অসম্পূর্ণ লিপি, যেটা গাণিতিক হিসাবকাজেই শুধু ব্যবহার করা যেত, কবিতা লেখায় নয়। তবে ৩০০০ BC থেকে ২৫০০ BC এর মাঝে সুমেরীয় লিপি পূর্ণাঙ্গ লিপিতে পরিণত হয়, যাকে আমরা আজ কিউনিফর্ম বলি। ২৫০০ BC এর মাঝে রাজারা ও পুরোহিতরা কিউনিফর্ম ব্যবহার করা শুরু করে, কম অভিজাত নাগরিকরাও। প্রায় একই সময়ে মিশরীয়রা হায়ারোগ্লিফিক্স এর বিকাশ ঘটায়। চীনে ১২০০ BC এবং আমেরিকায় ১০০০-৫০০ BC আগে পূর্ণাঙ্গ লিপির বিকাশ ঘটে। নবম শতাব্দীর কিছু আগে ০-৯ কে প্রতিনিধিত্ব গাণিতিক লিপি উদ্ভাবিত হয় যা হিন্দুদের দ্বারা উদ্ভাবিত হলেও আরবি সংখ্যা হিসেবে পরিচতি পায় কারণ ভারত আক্রমণের সময় তারা এই পদ্ধতির সাথে পরিচিত হয়।তারা এর উপযোগিতা বুঝতে পেরে এটিকে পরিশীলিত করে মধ্য প্রাচ্য ও ইউরোপে ছড়িয়ে দেয়৷ বর্তমানে শুধু ০ এবং ১ ভিত্তিক বাইনারি লিপি কম্পিউটার জগতে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে।

Andean রা হিসাব রাখার জন্য বিভিন্ন রং এর রশিতে গিঁট দিয়ে তথ্য সংরক্ষণ করতো যেটাকে কিপু বলা হতো। ইনকা সাম্রাজ্যের অধীনে কিপু আরো বিকাশ লাভ করে। স্প্যানিশরা যখন দক্ষিণ আমেরিকা জয় করে তখন ইনকা হতে কিপু স্প্যানিশদের হাতে হস্তান্তরিত হয়। কিন্তু স্থানীয় কিপু বিশেষজ্ঞরা তাদের স্প্যানিশ কিপু সম্পর্কে না জানা ভূস্বামীকে কিপুর ভুল অর্থ বুঝিয়ে সহজে প্রতারণা করতে পারতো। তাই কিপু পদ্ধতিকে বাতিল করে স্প্যানিশরা সেখানে ল্যাটিন লিপি প্রচলন করে এবং কিপুর সাথে কিপু পড়ার কৌশলও হারিয়ে যায়। তবে বিপরীতভাবে, হিব্রু বাইবেল, গ্রীক ইলিয়াড, হিন্দু মহাভারত, বৌদ্ধের ত্রিপিটক সবই শুরু হয়েছিলো মৌখিক কাজ হিসেবে। বহু প্রজন্ম ধরে এগুলি মুখে মুখে হস্তান্তরিত হয়েছিলো এবং লিখন পদ্ধতি উদ্ভাবিত না হলেও এগুলো টিকে থাকতো। তবে পড়ালেখা ও লিপি আবিষ্কারের থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো তালিকা করা, অভিধান, বর্ষপঞ্জী, ফর্ম ও ট্যাবলেটের ব্যবহার। সুমেরীয়রা লিপিকারের পাশাপাশি করণিক, গ্রন্থাগারিক এবং হিসাবরক্ষক নিয়োগের জন্য স্কুলগুলিতে অর্থ বিনিয়োগ করেছিলো। এবং এখান থেকে কর্মবিভাজন ও আমলাতন্ত্রের পথ তৈরী হয়েছে।

কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া মানুষের মস্তিষ্ক রিলেটিভিটি বা কোয়ান্টাম মেকানিক্স এর মত ধারণার মাধ্যমে চিন্তা করতে অক্ষম। তা সত্ত্বেও পদার্থবিজ্ঞানীরা তাই করতে সক্ষম হন, কারণ তারা চিন্তার ঐতিহ্যগত বাহ্যিক তথ্য পদ্ধতির পরিবর্তে প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতির সাহায্যে নতুন চিন্তা করতে শিখে। লিখনের জন্ম হয়েছিলো মানুষের চেতনার দাস হিসেবে, কিন্তু ক্রমবর্ধমানভাবে মানুষ এটির নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠছে।

 

There is No Justice in History

শ্রেণীবৈষম্য ইতিহাসে সর্বদাই ছিলো এবং আছে, এবং সজ্ঞানে আমরা কেউ এর দায় স্বীকার করি না। আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সকল মানুষ সমান ঘোষণা করা হলেও নারী-পুরুষ বৈষম্য, সাদা-কালো বৈষম্য তখন justified ছিলো। দাবি করা হয়, প্রকৃতি যোগ্যতরকে সম্পদ দিয়ে পুরস্কৃত করে, শ্রমবিমুখতাকে দন্ডিত করে। ইতিহাসের একটি কঠোর নিয়ম এই যে, প্রতিটি কল্পিত শ্রেণী-বৈষম্যকে অপরিহার্য হিসেবে দাবি করা হয়। শেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীকে জিজ্ঞেস করা হলে বিভিন্ন জাতির জৈবিক পার্থক্য নিয়ে অপবিজ্ঞান শুনতে হবে। রক্ষণশীল পুঁজিবাদী মনে করে পুঁজিবাদ দক্ষতার বাস্তব পার্থক্যের অনিবার্য ফল। তাদের মতে, ধনীরা যেহেতু অধিক সক্ষম ও পরিশ্রমী, তারা অধিকতর ভালো শিক্ষা ও পুষ্টিলাভ করলে কারো বিরক্ত হওয়া উচিত নয়। দক্ষিণ আফ্রিকার একটি সমুদ্র সৈকতে আইন করা রয়েছে যে সেখানে কৃষ্ণাঙ্গরা যেতে পারবে না যদিও সূর্যালোকে শেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গদের চেয়ে বেশি vulnerable. অর্থাৎ দক্ষিণ আফ্রিকার এই বিভাজনের বায়োলজিক্যাল যুক্তি নেই। কেন তবে ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় সমাজে জাতের ভিত্তিতে, আমেরিকান সমাজে বর্ণের ভিত্তিতে, অটোমান সমাজে ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য?

শ্রেণী বৈষম্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। একজন মানুষের সাথে কিভাবে অগ্রসর হওয়া উচিত সেটার ধারণা পাওয়া যায়। যেমন একটি রেস্টুরেন্টে সবার ওয়ালেটের অবস্থা, রুচি জানা সম্ভব না। কিন্তু পোষাক, আচরণ ইত্যাদির পার্থক্য থেকে একজন ওয়েটার ধারণা করতে পারেন যে একজন টেক্সাসের স্থানীয় মানুষ স্টেক খেতে সম্ভবত আগ্রহী এবং একজন হিন্দু ব্রাহ্মণ নিরামিষে৷

৩০০০ হাজার বছর পূর্বে ইন্দো আর্যরা ভারতীয় উপমহাদেশে আক্রমণ করে স্থানীয়দের পরাজিত করেছিলো। কিন্তু আর্যরা সংখ্যায় ছিলো কম, তাই স্থানীয়দের বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করে তাদের পেশা নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলো। শ্রেণীবৈষম্যের গোড়া যে দূষণের ভয়, সেটা পুরোপুরি পুরোহিত বা শাসকদের প্রতারণা নয়। সহজাত প্রবৃত্তি অনুসারেই মানুষ চায় না কালের পরিক্রমায় নিকৃষ্টদের সাথে প্রজনন করে বা তাদের বংশধরের মাঝে খারাপ জিন প্রবেশ করুক বা সামাজিকভাবে তাদের নিকৃষ্ট আচরণের সংস্পর্শে আসুক। এইজন্য যারা ভারতীয় সমাজে অস্পৃশ্য ছিলো, তাদের সাথে সর্বনিম্ন স্তরের মানুষও মিশতো না৷

আমেরিকায় ১৭ ও ১৮ শতাব্দীতে ইউরোপীয় বিজয়ীরা আমেরিকার খনি ও চাষের কাজে আফ্রিকা থেকে লক্ষ লক্ষ ক্রীতদাস আমদানি করেছিলো। এর কারণ ছিলো তিনটি- আফ্রিকা ছিলো নিকটে, আফ্রিকায় ততদিনে ক্রীতদাসের বাজার গড়ে উঠেছিলো এবং আমেরিকার চাষাবাদের স্থানে যে রোগগুলো গড়ে উঠেছিলো (ম্যালেরিয়া, পীতজ্বর) তার বিরুদ্ধে আফ্রিকানরা জেনেটিক ইনিউনিটি অর্জন করেছিলো। স্ববিরোধী মনে হলেও, জেনেটিকালি শ্রেষ্ঠতা সামাজিক নিকৃষ্টতায় পরিণত হয়৷ ১৮৬৫ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীতে দাসত্ব বেআইনি ঘোষিত হলেও স্টিগমা রয়ে গিয়েছিলো। ১৮৬৫ সালের পরে একজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি প্রতিবেশী শেতাঙ্গের চেয়ে ভালো চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা কম ছিলো সমান যোগ্যতা থাকলেও। ফলে কৃষ্ণাঙ্গরা সুযোগের অভাবে আরো পিছিয়ে গেলো এবং শেতাঙ্গরা এর সুযোগ নিয়ে বলা শুরু করলো " কালোরা ১৮৬৫ সালে মুক্তি পাওয়া সত্ত্বেও তাদের কেউ আইনজীবী,ডাক্তার বা ব্যাংকার হতে পারে নি।" সময়ের সাথে স্টিগমা আরো শক্ত হতে থাকলো, "জিম ক্রো" আইনে শ্রেণীবৈষম্য আইনকে রক্ষা করা হলো। নির্বাচনে কৃষ্ণাঙ্গরা ভোট দিতে পারতো না, শেতাঙ্গরদের স্কুলে পড়তে পারতো না, শেতাঙ্গদের রেস্তোরায় আহার করতে পারতো না, হোটেলে রাত্রিযাপন করতে পারতো না এমনকি ১৯৬০ এর দিকেও। ক্লেনন কিং নামে একজন কৃষ্ণাঙ্গ শিক্ষার্থী ১৯৫৮ সালে মিসিসিপি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করার জন্য তাকে আদালত মানসিক আশ্রয়ালয়ে পাঠায়। The ku Klax Klan নামে শেতাঙ্গ এক্সট্রিমিস্ট গোপন সোসাইটি শেতাঙ্গ কৃষ্ণাজ্ঞ মিশ্রণের জন্য অনেকগুলো হত্যাকান্ড ঘটিয়েছিলো। এভাবেই ইতিহাসে যারা একবার বলি হয়েছে, তারা বারবার এর শিকার হয়েছে। আর ইতিহাস যাদের সুবিধা দিয়েছে, তারা বারবার তা লাভ করার সুযোগ পেয়েছে।

বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন বৈষম্য থাকলেও নারী-পুরুষ বৈষম্য ছিলো সার্বজনীন। কন্যা সন্তাম হত্যা করা ছিলো বৈধ, কারো সম্পত্তি নয় এমন মেয়ে ধর্ষণ করা ছিলো বৈধ, যেমন রাস্তায় হারানো পয়সা কুড়ানোকে চুরি বলে গণ্য করা হতো না। ম্যারিটাল রেপ ছিলো নিজের মানিব্যাগ থেকে টাকা চুরি করার মত অযৌক্তিক। তবে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানব সংস্কৃতি পর্যবেক্ষণ করেছে যে সমকামী সম্পর্ক কেবল বৈধই নয় এমনকি সামাজিকভাবে গঠনমূলক। গ্রীস এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। ইলিয়াডে উল্লেখ করা হয় নি যে পুত্র একিলেসের সাথে প্যাট্রোক্লিসের সম্পর্কে থেটিসের কোন আপত্তি ছিলো। মেসডন রাণী অলিম্পিয়াস উষ্মা প্রকাশ করেন নি যখন তার পুত্র আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট তার প্রেমিক হেফায়েষ্টিয়নকে বাড়িতে ডিনারের জন্য নিয়ে আসে।

খ্রিষ্টান ধর্মতাত্ত্বিকরা যুক্তি দেন যে ইশ্বর মানবদেহ সৃষ্টি করেছেন প্রত্যেকটি অঙ্গ ও প্রত্যাঙ্গ একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য। আমরা এখন মুখ খাওয়ার লাশাপাশিও চুমু খেতে ও কথা বলতে ব্যবহার করি। নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য পূরণ করাই লক্ষ্য হলে আমাদের কৃমির মত ৬০০ মিলিয়ন বছর আগের পূর্বপুরুষের মুখ কি আর বিবর্তিত হত? বা পতঙ্গের সূর্যালোক শোষণকারী বাম্প উড়ার জন্য পাখায় রূপান্তরিত হতো? একইভাবে আমাদের যৌনাঙ্গও নির্দিষ্ট প্রয়োজনের গন্ডি পেরিয়ে সামাজিক প্রয়োজনেও ব্যবহৃত হয়, শুধু প্রজননের জন্যই আমরা সেক্স করি না। এমনকি শিম্পাঞ্জিও রাজনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করতে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়৷

প্রাচীন এবং আধুনিক এথেন্সের নারীর উভয়ের XX chromosomes থাকলেও উভয়ের ভোটাধিকার, শিক্ষা, অধিকার ভিন্ন ছিলো। আবার অষ্টাদশ শতাব্দীর XY chromosome এর অধিকারী লুই চতুর্দশ লম্বা উইগ, উঁচু হিলের জুতা পরিধান, নর্তকী ভঙ্গিতে দাড়ালেও সেটা ওই সময় পুরুষালী ছিলো এবং বর্তমান সময়ে সেটাকে মেয়েলি মনে করা হয়। আবার XY chromosome এর অধিকারী বারাক ওবামার পরিচ্ছদ লুই চতুর্দশ থেকে ভিন্ন। অর্থাৎ 'পুরুষত্ব' এবং 'নারীত্ব' ইন্টার সাবজেক্টিভ এবং তা অনবরত পরিবর্তন হচ্ছে৷ পুংলিঙ্গ বা নারীলিঙ্গের সদস্য হওয়া সহজ কাজ, XY বা XX ক্রোমোজম থাকলেই হয় কিন্তু সমাজে পুরুষ বা নারী হয়ে ওঠা কঠিন কাজ। কারণ নারী-পুরুষকে আমরা ক্রোমোজমের ভিত্তিতে আদিম সমাজে ডিফাইন করি নি, সামাজিক ভিত্তিতে করেছি এবং এখনো সেটাই করি। পুরুষকে অবিরত তার পৌরুষ এর প্রমাণ দিতে হয়, নারীকে অবিরত উপলব্ধি করাতে হয় যে সে যথেষ্ট ফেমিনিন।

মুষ্টিমেয় কয়েকজন নারীই শুধু নিজেকে আলফা অবস্থানে নিয়ে যেতে পেরেছেন, যেমনঃ ক্লিওপেট্রা, চীনের সম্রাজ্ঞী উ জেটিয়ান এবং ইংল্যান্ডের রাণী এলিজাবেথ প্রথম। তাও এলিজাবেথের রাজত্বের সময় সংসদের সকল সদস্য ছিলেন পুরুষ। কেন প্রায় সব সংস্কৃতিতে নারীত্বের চেয়ে পুরুষত্ব মূল্যবান তার কিছু সর্বজনীন বায়োলজিক্যাল কারণ আছে৷ অনেক তত্ত্ব আছে, যদিও তার কোনটাই বিশ্বাসযোগ্য নয়।পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অনুগত নারীরাই টিকে থাকতে পেরেছিলো, ক্ষমতা আগ্রাসী নারীরা পারে নি। তাই অনুগত হওয়ার বৈশিষ্ট্যের জিন পরবর্তী প্রজন্মে হস্তান্তর হয়েছিলো এবং ক্ষমতাবান নারীদের জিন পরবর্তী প্রজন্মে যেতে পারে নি। পেশী শক্তি একটা কারণ দেখান অনেকে, কিন্ত নারীরা অধিক ক্ষুধা, রোগ, ক্লান্তি প্রতিরোধী হয়। আর ইতিহাস জুড়ে শারীরিক পরিশ্রমের কাজে নারীদের অব্যাহতি দেওয়ায় তারা শারিরীকভাবে শক্তিশালী হিসেবে বিবর্তিত হয় নি। আর শারীরিক শক্তির সাথে সামাজিক ক্ষমতারও সম্পর্ক নেই। তাহলে ক্রীতদাসরা আমেরিকা শাসন করতো, বৃদ্ধরা পলিটিশিয়ান হতো না। আর সামরিক দিক থেকে সফল আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, নেপোলিয়ন স্থিতিশীল শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি, কিন্তু সামরিক দিক দিয়ে অযোগ্য রোমান এম্পেরর অগাষ্টাস পেরেছিলেন। নারীরা অন্যদের দৃষ্টিকোণ থেকে সবকিছু ভালোভাবে অবলোকন করতে পারে। কাজেই নারীদের চমৎকার রাজনীতিবিদ হওয়ার সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন ছিলো কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন কমই দেখা যেত। কেন তা পরিষ্কার নয়।



Popular Posts