Sapiens Synopsis E03: The Unification of Humankind


The Arrow of History

ইতিহাসের কি কোন নির্দিষ্ট গতিপথ আছে? নাকি এর প্রবাহ একেবারেই বিক্ষিপ্ত? মোঙ্গল সাম্রাজ্য এশিয়ার বিশাল অংশ এবং ইউরোপের কিছু অংশেও শাসন কায়েম করেছিলো, শুধু একসময় ভেঙে যাওয়ার জন্য। খ্রিষ্টধর্ম কোটি মানুষে ছড়িয়েছে বহু সম্প্রদায়ে বিভক্ত হওয়ার জন্য। ল্যাটিন ভাষা বিস্তার লাভ করে শুধু স্থানীয় উপভাষায় বিভক্ত হওয়ার জন্য। ইতিহাসের গতিপথ বুঝতে হলে আমাদের ঈগল পাখির চোখ দিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা দেখার মত করে দেখতে হবে একসাথে। তাহলে দেখা যাবে, ইতিহাসের প্রবাহে খ্রীষ্টধর্মকে সাম্প্রদায়ীকরণ এবং মোগল সাম্রাজ্যের পতনের মত বাধ বা স্পিডব্রেকার রয়েছে।

কৃষি বিপ্লবের পর মিথ এবং ফিকশান প্রচুর বিস্তৃত হয় এবং সংস্কৃতি গড়ে তোলে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে পন্ডিতরা মনে করতেন সংস্কৃতি অপরিবর্তনীয়। তবে বর্তমান পন্ডিতরা বলেন, সংস্কৃতি অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব প্রশমিত করতে থাকে এবং এই প্রক্রিয়া পরিবর্তনের জ্বালানি হিসেবে কাজ করে।

১৫২১ এ স্প্যানিশরা Aztec এবং ১৫৩২ এ ইনকা সাম্রাজ্য জয়ের পর স্প্যানিশরা আমেরিকার বড় অংশে বিজয় লাভ করে। ১৬০৬ সালে ইউরোপীয়রা অষ্ট্রেলিয়ায় আসে এবং ১৭৮৮ তে ব্রিটিশ উপনিবেশের পত্তন হলে আদিম অষ্ট্রেলিয়ার পতন ঘটে। এভাবে বিশ্বায়নের জন্য সংস্কৃতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়ে, একটা ভালো উদাহরণ হলো রন্ধন।

 চকলেট সুইজারল্যান্ডের বা মশলা ইন্ডিয়ার স্থানীয় নয়। টমেটো, মরিচ, কোকো মূলত মেক্সিকান, স্পেনীয়রা মেক্সিকো জয় করার পরই এগুলো মূলত ইউরোপ ও এশিয়ায় পৌছায়। জুলিয়াস সিজার এবং দান্তে আলেগিয়েরি কখনো স্প্যাগেটি খেতে পারেননি, উইলিয়াম টেল চকলেটের স্বাদ কখনো পাননি, বুদ্ধ কখনোই মশলা হিসেবে মরিচ ব্যবহার করেননি। ১৪৯২ তে টেক্সাসে স্টেক পাওয়া যেত না, ইংল্যান্ড আর পোল্যান্ডে আলুও পাওয়া যেত না। সাম্রাজ্যের বিস্তার এবং মানবজাতির একীভবনের সাথে মেক্সিকোর মশলা ইন্ডিয়াতে এবং স্পেনের গবাদি পশু আর্জেন্টিনার চারণভূমিতে পৌছায়।

 খ্রীষ্টপূর্ব সহস্রাব্দে তিনটি সম্ভাব্য সর্বজনীন নিয়মের আবির্ভাব ঘটে - অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়। বণিক, বিজয়ী, নবীরা সর্বপ্রথম সমগ্র মানব ঐক্যকে কল্পনা করতে পেরেছিলেন। তবে একই রাজাকে মান্য না করলেও এবং একই ধর্মে সবাই বিশ্বাসী না হলেও সবাই একই অর্থের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন। লাদেন আমেরিকার সংস্কৃতি ঘৃণা করলেও আমেরিকার ডলার ভালোবাসতেন।

The Scent of Money

অর্থের লোভ এক অদ্ভুত জিনিস। খ্রিষ্টানরা বিজয় লাভ করার পর তারা মসজিদ ধ্বংস করেই বিজয় চিহ্নিত করে নি, ক্রুশ চিহ্নিত স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা চালু করেছিলো এবং বিধর্মীদের সাথে লড়াইয়ে ইশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলো। খ্রিষ্টানরা তাদের মুদ্রাতে আরবি হরফে ঘোষণা করেছিলো "আল্লাহ ব্যাতীত কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল।" এমনকি মেলগিয়েল এবং এগডার ক্যাথলিক বিশপরাও জনপ্রিয় মুসলিম মুদ্রাগুলির বিশ্বস্ত কপি জারি করেছিলো আর ইশ্বরভীরু খ্রিষ্টানরা খুশি মনে এগুলো ব্যবহার করতো। অন্যপাশেও উত্তর আফ্রিকার মুসলিম বণিকরা ব্যবসা পরিচালনায় খ্রিষ্টীয় মুদ্রা ব্যবহার করতো। এমনকি মুসলিম শাসকরা যারা কাফের খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে জিহাদের আহবান জানিয়েছেন, তারাও আনন্দের সাথে কর হিসেবে খ্রিষ্ট ও কুমারী মাতার আহবান লেখা মুদ্রা গ্রহণ করতেন৷ মানুষ পরস্পরের সাথে দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বললেও, ভিন্ন দেবদেবী পূজা করলেও, ভিন্ন শাসককে মেনে চললেও সবাই রৌপ্য ও স্বর্ণমুদ্রায় বিশ্বাস করতো। অর্থ এমন এক জিনিস যেটাকে অন্য একজনের বিশ্বাস আপনার বিশ্বাসকে শক্তিশালী করে, এমনকি সেই ব্যক্তিকে আমরা যদি ঘৃণাও করি৷ তবে এই বিশ্বাসের অন্ধকার দিক হলো ওই ব্যক্তির অর্থ ফুরিয়ে গেলে ওই ব্যক্তির উপর আমাদের বিশ্বাসও ফুরিয়ে যায়, কারণ বিশ্বাসটা ছিলো অর্থের উপর, ব্যক্তির উপর নয়। অর্থের উপর বিশ্বাস যুগে যুগে মানবিক মূল্যবোধকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। পিতা-মাতা তাদের সন্তানকে দাস হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছে, ধর্মপ্রাণ খ্রিষ্টানরা হত্যা, চুরি ও প্রতারণা করেছে, সেই লুঠের অর্থ দিয়ে আবার গীর্জা বানিয়ে পাপমোচন করেছে। নাইটরা তাদের আনুগত্য বিক্রি করে রাজার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, আদিবাসীরা নিজেদের পিতৃভূমি বিক্রি করে দিয়েছে।

মুদ্রার প্রচলন আমাদের বিশ্বকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। প্রাচীনকালে অর্থনীতি ছিলো একটি পরিবার বা গোত্র বড়জোর গ্রামের মাঝেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু অর্থনীতি সীমিত হওয়ায় একটা গ্রামে ফুলটাইম ডাক্তার বা মুচি থাকা সম্ভব ছিলো না৷ মুদ্রা আসার আগে একটা সমস্যা ছিলো যে অপরিচিত মানুষ যারা প্রতিদান দিতে সক্ষম হবে না ওদের সাথে বিনিময় করা। আর মুদ্রা না থাকলে প্রতিটা পণ্যের সাপেক্ষে প্রতিটা পণ্যের আপেক্ষিক দাম জানা লাগতো। আবার একজন আপেল ব্যবসায়ীর জুতা ছিড়ে গেছে কিন্তু এই মুহূর্তে আইনজীবীর প্রয়োজন নেই। তাই সে মুচির কাছে আপেল বেচলেও আইনজীবীর কাছে বেচতে পারতো না। মুদ্রা আমাদের সম্পদ সঞ্চয় করতে আমাদের সাহায্য করে। স্ট্রবেরি পচে যেতে পারে, কিন্তু ব্যাংক নোট পচবে না। রিয়েল স্টেট কিনতে গেলে আজকের চেক বা ব্যাংকনোট বহন করা সহজ, কিন্তু মিশরের কোন আপেল ব্যাবসায়ীর পক্ষে সম্ভব নয় লন্ডনে ফ্ল্যাট কেনার জন্য সেখানে আপেল বহন করে নিয়ে যাওয়া। ইতিহাসের প্রথম মুদ্রা সুমেরীয়দের বার্লি মুদ্রা। এর একটি অন্তর্নিহিত বায়োলজিক্যাল মূল্য ছিলো, মানুষ এটি খেতে পারতো। তবে এটি সংরক্ষণ সহজ ছিলো না। এরপর মেসোপটিমিয়ায় রূপার শেকেল অর্থ হিসেবে প্রচলিত হয়, যা খাওয়া যেত না কিন্তু সংরক্ষণ করা সহজ ছিলো। কিন্তু এর সমস্যা ছিলো দুইটা। ওজন করা লাগতো আর বিশুদ্ধতা যাচাই করা লাগতো। এরপর ৬৪০ BC তে পশ্চিম আনাতোলিয়ায় লিডিয়ার রাজা এলিয়াটেস কর্তৃক প্রথম কয়েন প্রচলিত হয়। এটি আগে থেকেই ওজন ও নির্দিষ্ট বিশুদ্ধতার ছিলো বিধায় আরো সহজে ব্যবহার করা যেত। এবং মুদ্রা রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্য দ্বারা স্বীকৃত ছিলো এবং এর জালিয়াতি অন্যান্য প্রতারণা হতে কঠোরভাবে বিবেচনা করা হতো। তাই সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তিরা ডেনারিউস মুদ্রার বিষয়ে একমত হতে পারতো কারণ তারা রোমান সম্রাটের শক্তি ও সততার উপর বিশ্বাস করতো যার নাম মুদ্রায় অংকিত থাকতো। রোমের মুদ্রাতে মানুষের বিশ্বাস এত দৃঢ় ছিলো যে রোমের বাইরের মানুষও এমনকি হাজার কি.মি. দূরের ভারতবর্ষেও খুশিমনে ডেনারিউসে পেমেন্ট গ্রহণ করতো, মুসলিম খলিফারা এই নামকে আরবীকরণ করে 'দিনার' হিসেবে জারী করেছিলো।

 
কিন্তু অর্থ কোন বস্তুগত বাস্তবতা নয়, মানসিক নির্মাণ।আমরা কেন কিছু রঙিন কাগজ পেতে এত পরিশ্রম করি৷ কারণ আমার প্রতিবেশী ডলারে বিশ্বাস করে, তাই আমিও করি। আগামীকাল কেউ ডলার গ্রহণ না করলে আপনিও এটা সঞ্চয়ে ইচ্ছা হারাবেন। ২০০৬ সালে পৃথিবীর মোট অর্থ ৬০ ট্রিলিয়ন ডলার হলেও কয়েন ও নোটের পরিমাণ ছিলো ৬ ট্রিলিয়নেরও কম। অর্থাৎ ৯০% অর্থের অস্তিত্ব এখন কম্পিউটারে। কারণ একজন অপরাধীই স্যুটকেস ভর্তি ক্যাশ দিয়ে বাড়ি কিনতে আসবে, কোন ব্যাবসায়ী নয়। অর্থ অনেক উদ্ভট কাজে ব্যবহৃত হবার নজির আছে। যেমন অবৈধ যৌনক্রিয়ায় পাপের শাস্তি হতে পরিত্রাণ পেতে অর্থের বিনিময়ে পনের শতকে যৌনকর্মীরা অর্থের বিনিময়ে ক্যাথলিক চার্চে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে পাপ হতে নিষ্কৃতি ক্রয় করতো। আধুনিক কারাগার এবং POW শিবিরে সিগারেট প্রায় অর্থ হিসেবে ব্যবহৃত হয়৷ নাৎসি বন্দী শিবিরে রুটির দাম ১২ সিগারেট, ঘড়ি ৮০-২০০ সিগারেট আর এক লিটার ওয়াইন ৪০০ এলকোহলের বিনিময়ে পাওয়া যেত৷ অধূমপায়ীরাও খুশি হয়েই সিগারেট গ্রহণ করতো।

একবার দুটি অঞ্চল বাণিজ্যে লিপ্ত হলে সরবরাহ এবং চাহিদার শক্তিগুলি পরিবহনযোগ্য পণ্যগুলির মূল্যের সমতা মজায় রাখতে চায়। যেমন ভারতে স্বর্ণের দাম কম ছিলো এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে স্বর্ণের দাম বেশি ছিলো। তাই বণিকরা ভারত থেকে স্বর্ণ কিনে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে বিক্রয় শুরু করলো। এতে ভারতে স্বর্ণের চাহিদা বেড়ে গেলো এমনকি তাদের নিজেদের ব্যবহারে না আসলেও, তাই দাম বেড়ে গেলো, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে প্রাপ্যতা বেড়ে যাওয়ায় দাম কমে গেলো। এভাবে যতক্ষণ না দুই অঞ্চলে দাম সমান হয়, এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে৷

Imperial Visions

১৩৪ BC তে রোমানদের বিরুদ্ধে আইবেরিয়ার ন্যুমান্টিয়ানরা যখন বিদ্রোহ করে, জেনারেল এমিলিয়ানোস ৩০ হাজার সৈন্যের দল নিয়ে তাদের ঘেরাও করে এবং সারি সারি দুর্গ তৈরী করে বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। আক্রমণ না করে ন্যুমান্টিয়ানদের আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে তাদের রসদ ফুরিয়ে দেবার মাধ্যমে এবং ক্ষুধার্ত রেখে। ন্যুমান্টিয়ানরা তাদের শহর পুড়িয়ে দেয় এবং রোমানদের দাসত্ব স্বীকার না করে আত্মহত্যা করে। বর্তমান স্প্যানিশদের কাছে ন্যুমান্টিয়ানরা স্বাধীনতা ও বীরত্বের প্রতীক। ১৯৫০ ও ৬০ এর দশকে স্প্যানিশরা সুপারম্যান, স্পাইডারম্যানের কমিক্স পড়তো না, বরং আইবেরীয়দের অভিযান পড়তো। এই স্প্যানিশরাই রোমান ক্যাথলিক চার্চের অনুসারী এখন, স্প্যানিশ ভাষা একটি রোমানিক ভাষা এবং স্প্যানিশ আইন রোমান সাম্রাজ্যের আইন অনুসারেই বানানো। একবিংশ শতাব্দীর আমরা প্রত্যেকেই কোন না কোন সাম্রাজ্যের সন্তান।

আমাদের জানামতে সবচেয়ে প্রাচীন সাম্রাজ্য হলো আক্কাদিয়ান সাম্রাজ্য (২২৫০ BC)। এর সম্রাট ছিলেন সারগন এবং মেসোপটিমিয়ার ছোট্ট শহর কিশ থেকে ছিলো এর বিস্তৃতি। এরপর তিনি পারস্য উপসাগর থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেন। পরবর্তী ১৭০০ বছর Assyrian, ব্যাবিলনীয়রা সারগনকে রোল মডেল হিসেবে গ্রহণ করে এবং তারা মনে করতো তারা সমগ্র বিশ্ব জয় করে ফেলেছে৷ সাম্রাজ্যবাদের আগে মূল চেষ্টা ছিলো ভিন্ন জাতিকে দমন করা কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের মূলকথা হলো ভিন্ন জাতিকে নিজের অধীনে আনা। সম্রাটরা নিজেদের ধারণা, প্রতিষ্ঠান, আদর্শ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ছড়িয়ে দিতেন৷ পারস্যের সাইরাস ইহুদীদেরকেও নিজের অধিকারে এনেছিলেন, তাদের মন্দির নির্মাণের অনুমতি দিয়েছিলেন। বন্য জার্মান এবং গলরা অশান্তি ও অজ্ঞতার মাঝে বাস করতো যতক্ষণ না রোমানরা তাদের আইন দিয়ে বশ্য করেছে, স্নানাগারে পরিষ্কার করেছে এবং দর্শন দিয়ে উন্নত করেছে। মুসলিম খলিফারা নবীর ঐশী প্রত্যাদেশ ছড়িয়ে দিয়েছিলো, সম্ভব হলে শান্তিপূর্ণভাবে, প্রয়োজন হলে বলপ্রয়োগ করে। সপ্তম শতাব্দীতে পরাজিত মিশরীয়, সিরীয়, ইরানী এবং বর্বররা ধীরে ধীরে ইসলাম ধর্ম, আরবি ভাষা এবং সংস্কৃতি গ্রহণ করেছিলো। স্প্যানিশ ও পর্তুগীজরা দাবি করতো তারা আমেরিকা গিয়েছিলো সম্পদের জন্য নয়, বরং সত্য বিশ্বাসে ধর্মান্তরিত করার জন্য। মৌর্য সাম্রাজ্য অজ্ঞ বিশ্বের জন্য বুদ্ধের শিক্ষা বিস্তারের মিশনে নেমেছিলো। ২০০০ বছরের বেশি সময় ধরে জাতিগত ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীগুলির অরাজকতা চলার পর চীনা সাম্রাজ্যের সংস্কৃতিতে অঙ্গীভূত হয় এবং হান চীনা হয়ে উঠে (২০৬-২২০ AD)। বর্তমানে ৯০ শতাংশের বেশি চীনা নিজেদেরকে হান চীনা মনে করে। উদারনীতি ও মুক্তবাজারের যমজ ধারণা ছড়িয়ে দেওয়ার ব্রিটিশ মিশনে সূর্য কখনো ডুবতো না। এমনকি অনেক আমেরিকানরাও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় নাক গলানো জাস্টিফায়েড মনে করে, দরকার হলে F-16 অস্ত্র দিয়ে হলেও।

সাম্রাজ্যের সবসময় সীমারেখাকে অতিক্রম জাতি, অঞ্চল গ্রাস করার ক্ষুধা থাকে। তবে একটি সাম্রাজ্যের উত্থান সর্বদা সামরিক অভিযান থেকে হয় না। এথেনীয় সাম্রাজ্যের যাত্রা শুরু হয়েছিলো সেবামূলক লীগ হিসেবে, হাবসবার্গ সাম্রাজ্যের উত্থান বৈবাহিক সূত্রে। একটি সাম্রাজ্য স্বৈরাচারী পদ্ধতিতে শাসিত হওয়া আবশ্যক নয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শাসিত হতো। এই সাম্রাজ্যবাদ এখন বর্তমান ফ্যাসিবাদের সমতুল্য। একটি শোষক সাম্রাজ্য ধ্বংসের অর্থ ওই সাম্রাজ্যের নিপীড়িত মানুষের মুক্তি ছিলো না। বরং সিংহাসন রিলে রেসের ব্যাটনের মত শাসকদের হাতে যেত। নতুন শাসকের অধীনে তারা আবার নিপীড়িতই হতো। আদর্শ সাম্রাজ্য হলো যুদ্ধ, দাসত্ব, নির্বাসন এবং গণহত্যার উদ্দীপক। স্কটল্যান্ডের সেনানায়ক খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে রোমানদের বলেছিলেন 'পৃথিবীর দুর্বৃত্ত'৷ তবে তার মানে এই না যে সাম্রাজ্য ভালো কিছু রেখে যায় না। মোগলরা ভারতীয়দের শোষণ না করলে তাজমহল বানাতে পারতো না, হাবসবার্গ সাম্রাজ্য স্লাভিক, হাঙ্গেরিয়ান এবং রোমানভাষী প্রদেশগুলি থেকে শোষণ করা মুনাফা থেকে মোজার্টের কমিশন ও হেইডেনের বেতন দেওয়া হতো।

 সাম্রাজ্যগুলোও কখনো অতিমাত্রায় গোঁড়া থাকতে পারে নি। রোমান সাম্রাজ্য ছিলো যতটা রোমান ততটাই গ্রীক। ৪৮ শতাব্দীতে রোমান সম্রাট ক্লডিয়াস কয়েকজন বিশিষ্ট গলকে সেনেট পদে নিযুক্ত করেন। অন্য উন্নাসিক সেনেটরা প্রতিবাদ করলে ক্লডিয়াস মনে করিয়ে দেন, তারাও ইতালীয় উপজাতি হতে বংশদ্ভুত, যারা একসময় রোমের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলো। দ্বিতীয় শতাব্দীতে রোম আইবেরীয় সম্রাটদের অধীনে ছিলো। ট্রাজান, হাড্রিয়ান, এন্টোনিনিয়াস পায়াস, মার্কাস অরেলিয়াসের রাজত্বকে রোমান সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগের প্রতিষ্ঠা মনে করা হয়। সম্রাট সেপটিমিয়ায় সেভেরাস লিবিয়ার একটি অভিজাত পিউনিক পরিবারে জন্মেছিলেন৷ সম্রাট ফিলিপ 'ফিলিপ অফ দা Arab' হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মঙ্গল সাম্রাজ্যের সংস্কৃতি ছিলো চীনা অনুকরণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেনিয়ার রক্তের প্রেসিডেন্ট ইতালিয়ান পিজ্জা খেতে পারেন ব্রিটিশ মুভি 'লরেন্স অফ এরাবিয়া' দেখতে দেখতে যা তুর্কিদের বিরুদ্ধে আরবদের বিদ্রোহের কাব্য৷ তবে এই সাংস্কৃতিক মিশ্রণ যে পরাজিতদের জীবন সহজ করে দিয়েছিলো তা নয়। ন্যুয়ান্তিয়ানদের পতনের একশো বছর পরে একজন আইবেরীয় নিখুত ল্যাটিন ভাষায় কথা বললেও, রোমান পোষাক পরলেও, ব্যাবসায় সফল হয়ে রোমান ধাচে বাড়ি বানালেও এবং তার স্ত্রী রোমান অভিজাতদের মত গহনা পরলেও এবং ভার্জিলের বুক থ্রি জার্জিক্স মুখস্ত পাঠ করলেও রোমানরা তাকে আধা বর্বরই মনে করতো। গান্ধী লন্ডনের ভার্সিটি থেকে ল পড়ে আসলেও এবং পশ্চিমা সংস্কৃতি আত্মস্থ করে আসলেও কালারড পার্সন হওয়ায় তাকে দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রেন থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু এত কিছুর পরেও সাম্রাজ্যের রেখে যাওয়া সংস্কৃতি সাম্রাজ্যের পতনের শত শত বছর পরেও বেচে রয়েছে। আধুনিক ভারতীয় রাষ্ট্র হলো বৃটিশ সাম্রাজ্যের একটি সন্তান। যেমন ইন্ডিয়ানরা এখন শার্ট এবং কোট পরে, ক্রিকেট খেলা এবং চা পানে অনুরাগী, দুইজন ভারতীয় চোস্ত ইংরেজীতে কথা বলতে পারলে যত খুশি হয়, পৃথিবীর আর কিছুতে হয় না।

আধুনিক ইহুদীরা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক প্রথাগুলির জন্য প্রাচীন জুডিয়া ঐতিহ্যের থেকে গত দুই সহস্রাব্দ ধরে যে সকল সাম্রাজ্যের অধীনে বসবাস করছিলো, সেগুলির কাছে বেশি ঋণী। যদি কিং ডেভিড বর্তমান জেরুজালেমের কোন অতি গোঁড়া সিনাগগে যেতেন, পূর্ব ইউরোপের পোষাক পরা মানুষ দেখে বিস্মিত হতেন এবং জার্মান ডায়ালেক্টে কথা বলা ও ব্যাবিলনীয় গ্রন্থ তালমুদের পাঠাংশের তর্ক বিতর্ক দেখে বিস্মিত হতেন। সময়ের সাথে একটি জাতির উপর অনেক সংস্কৃতির মিশ্র প্রভাব পড়ে। আমাদের অধিকাংশ সংস্কৃতিতে আছে কোন না কোন সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, আমাদের সংস্কৃতি অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই সাম্রাজ্য থেকে এসেছে যেগুলো আমাদের পূর্বপুরুষকে শোষণ করেছে। পূর্ব এশীয়দের ভাষা এসেছে হান ভাষা থেকে। বর্তমান মিশরীয়রা আন্তরিকভাবে নিজেদেরকে আরবজাতি মনে করে, অথচ এই মিশরীয়দেরকে সপ্তম শতাব্দীতে আরবীয়রা বিদ্রোহ করলে নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছিলো। উনবিংশ শতাব্দীতে দক্ষিণ আফ্রিকার এক কোটি জুলু তাদের পুরনো ঐতিহ্যে ফিরে গিয়েছিলো, যদিও তাদের পূর্বপুরুষরা জুলু সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত অভিযানে লিপ্ত ছিলো।

একুশ শতকে অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করে যে কোন একটি নির্দিষ্ট জাতির সদস্যদের চেয়ে পুরো মানবজাতি হচ্ছে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের বৈধ উৎস এবং মানবাধিকার রক্ষা ও পুরো মানবজাতি স্বার্থ রক্ষাই রাজনীতির উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর মত বিষয়গুলোতে এখন সব রাষ্ট্রকে একসাথে কাজ করতে হয়। রোমান বা মঙ্গোলীয় সাম্রাজ্যের যেমন লক্ষ্য ছিলো যতটা সম্ভব অধিক অঞ্চলকে শাসন করা, আধুনিক ফ্রান্স বা ভারতের লক্ষ্য তেমন নয়। বিশ্বায়নে পুরো বিশ্বই হয়ে উঠেছে সাম্রাজ্য, a global empire.

The Law of Religion

আজ ধর্ম প্রায়শ বৈষম্য, মতবিরোধ, অনৈক্যের উৎস। তবুও প্রকৃতপক্ষে ধর্ম হচ্ছে সম্পদ ও সাম্রাজ্যের পাশাপাশি মানবজাতির একত্রিত হওয়ার তৃতীয় মহান উপায়। বড় সমাজ প্রায়শ ভঙ্গুর হয়, আর এই ভঙ্গুর কাঠামোগুলোকে একত্রে রাখতে সর্বোচ্চ অসীম কর্তৃপক্ষের ঐশ্বরিক বৈধতা দিতে ধর্মকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়েছে।

 কৃষি বিপ্লবের পূর্বে প্রধান বিশ্বাস ছিলো সর্বপ্রাণবাদ। তারা বটগাছের আত্মা বা সাদালেজ শিয়ালের আত্মাকে অলৌকিক শক্তির অধিকারী ভাবতো। তখন ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ ছিলো খুবই স্থানিক। অধিকাংশ যাযাবর দল তাদের জীবন যাপন করতো সর্বোচ এক হাজার বর্গকিলোমিটারের মাঝে, আর তারা দূরবর্তী অঞ্চলের অধিবাসীদের নিজেদের বিশ্বাসে সম্মত করায় আগ্রহী ছিলো না, যেমন বর্তমান সময়ের ইসলাম বা খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচারমুখী। কৃষিবিপ্লবের সাথে সাথে ধর্মীয় বিপ্লবের উত্থান হয়, সর্বপ্রাণবাদ জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীকে অলৌকিক কাতারে না ফেলে বরং মানুষের সম্পদে পরিণত করা হয়। কিন্তু অনেক কিছু ছিলো মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যেমনঃ মহামারী, সুস্থ মেষশাবকের জন্ম নিশ্চিত করা ইত্যাদি। তাই দেবতারা হয়ে উঠলো গুরুত্বপূর্ণ, দেবতাদের উপর দায়ভার দেওয়া হতো যেন তারা এইসব সমস্যা সমাধান করে। প্রাচীন পুরানের অধিকাংশই আসলে একটি বৈধ চুক্তি যার মধ্যে উদ্ভিদ ও প্রাণীদের উপর প্রভুত্বের বিনিময়ে মানুষ চিরস্থায়ী ইশ্বরভক্তির প্রতিশ্রুতি দেয়।

 সাম্রাজ্য ও বাণিজ্যের নেটওয়ার্কগুলি প্রসারিত হলে, মানুষের প্রয়োজন হয় এমন সত্ত্বার যার ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব সমগ্র এলাকা জুড়ে বা বিশ্ব জুড়ে। ফলে উত্থান হলো বহু-ইশ্বরবাদের৷ যেমন গ্রিক বহু-ইশ্বরবাদ (জিউস, হেরা, এপোলো প্রমুখ দেব-দেবী নিয়ে)। সর্বপ্রাণবাদীরা মনে করতো যে মানবরা পৃথিবীতে বসবাসকারী অনেক প্রাণীদের মাঝে একটি। অন্যদিকে বহু-ইশ্বরবাদীরা ক্রমশ বিশ্বকে দেখেছিলো মানবজাতি ও ইশ্বরের মধ্যকার সম্পর্কের একটি প্রতিচ্ছবি হিসেবে। এই কারণেই বহু-ইশ্বরবাদে কেবল দেবতাদেরই মর্যাদা দেওয়া হয় নি পাশাপাশি মানবজাতিকেও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।

 বহু-ইশ্বরবাদের উপলব্ধি হচ্ছে অনন্য শক্তি বিশ্ব পরিচালনা করে এবং তা স্বার্থ ও পক্ষপাতহীন, মানুষের জাগতিক আকাঙ্ক্ষা, যত্ন ও উদ্বেগের প্রতি নির্বিকার। তাই গ্রীকরা ভাগ্যদেবীর উদ্দেশ্যে কোন উৎসর্গ অপচয় করতো না আর হিন্দুরা আত্নার জন্য কোন মন্দির প্রতিষ্ঠা করতো না। আর এইজন্যই বহু-ইশ্বরবাদের মূল দর্শনটি ধর্মীয় সহিষ্ণুতার জন্য অনেক বেশি সহায়ক। বহু-ইশ্বরবাদ সহজাতভাবে মুক্তচিন্তার হয়ে থাকে, আর কদাচিৎ বিপথগামী হয় এবং অবিশ্বাসীদের হত্যা করে না। মিশরীয়, রোমান ও Aztec রা বিজয়ী অঞ্চলে কখনো নিজেদের ধর্ম প্রচারে উৎসাহী ছিলো না। খ্রীষ্টের ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার পর থেকে ৩০০ বছর পর রোমান সম্রাট কনস্টান্টিনের ধর্মান্তরিত হওয়া পর্যন্ত রোমান বহু-ইশ্বরবাদীরা যত খ্রিস্টানকে হত্যা করেছে, ১৫৭২ সালের ২৩ আগষ্ট ক্যাথলিকরা প্রোটেষ্ট্যান্টদের উপর ২৪ ঘন্টায় যে গণহত্যা চালায়, তার চেয়ে কম। বহু-ইশ্বরবাদীরা যেখানে সহিষ্ণু ছিলো, সেখানে একই খ্রিষ্টের দেবত্ব ও গসপেলে বিশ্বাসী খ্রিষ্টানদের দুই ভাগ ক্যাথলিক ও প্রোটেষ্ট্যান্টরা পাশাপাশি শান্তিপূর্ণভাবে থাকতে পারলো না।

সময়ের সাথে বহু-ইশ্বরবাদের কিছু অনুসারী বিশেষ অভিভাবকের প্রতি এত অনুরাগী হয়ে পড়ে যে তারা মৌলিক ইশ্বরবাদ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলো এবং বহু-ইশ্বরবাদ বিভিন্ন স্থানে একেশ্বরবাদের জন্ম দিতে থাকে। খ্রীষ্টপূর্ব ১৩৫০ সালে প্রথম একেশ্বরবাদী ধর্মের আবির্ভাব ঘটে, ফ্যারাও আখেনাতেন দেবতা আতেনের উপাসনাকে রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন এবং অন্যান্য সকল দেবতার উপাসনা প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। অবশ্য এই ধর্মীয় বিপ্লব ব্যর্থ হয়, আখেনাতেন মারা যাওয়ার পর আতেনের উপাসনা বর্জন করা হয়।

শুরুর দিকে ইহুদীধর্ম প্রচারমুখী ছিলো না, এই পর্যায়কে বলা যায় 'স্থানীয় একেশ্বরবাদ'। খ্রিষ্টধর্মের উত্থান যখন হয় একটি দুর্বোধ্য ইহুদী সম্প্রদায় থেকে, তারা ইহুদীদের বুঝানোর চেষ্টা করতো, তোমরা যে মসিয়ার জন্য অপেক্ষা করছো, নাজারাথের যীশুই হলো সেই দীর্ঘ প্রতিক্ষীত মসিহ। টারসাসের পল যুক্তি দিয়েছিলেন, যদি মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ শক্তি যদি মানবজাতির পরিত্রাণের জন্য ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন, তবে তার সম্পর্কে কেবল ইহুদী নয়, সবারই শোনা উচিত। এভাবে যীশু সম্পর্কে গসপেল সারা পৃথিবীতে প্রচার করা হতে থাকে। শুরু হয় প্রচারমুখী ধর্মের যুগ। বহু ইশ্বরবাদীদের তুলনায় একেশ্বরবাদীরা আরো বেশি কট্টর ও প্রচারমুখী হতে থাকে। কারণ যেহেতু একেশ্বরবাদীরা বিশ্বাস করতো একমাত্র তাদের হাতেই রয়েছে ইশ্বরের সমগ্র বার্তা, তারা অন্যান্য ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণু হয়েছে এবং সহিংস হয়েছে। পঞ্চম শতকে রোমান সাম্রাজ্য আটলান্টিক মহাসাগর থেকে হিমালয় পর্যন্ত যতদূর সম্ভব খ্রিষ্টান ধর্ম প্রসারে জোর দিয়েছিলো। তবে একেশ্বরবাদ দেবতাদের ঘটা করে সামনের দরজা দিয়ে বহিষ্কার করলেও পিছনের দরজা দিয়ে ফিরে এসেছিলো, যেমন - খ্রিষ্টধর্ম নিজেদের সেইন্ট তৈরী করেছিলো যাদের ধর্মানুষ্ঠানিকতা বহু-ইশ্বরবাদীদের থেকে সামান্যই ভিন্ন ছিলো। প্রতিটি খ্রিষ্টীয় সাম্রাজ্যের ছিলো নিজস্ব পৃষ্ঠপোষক সেইন্ট। খ্রিষ্টধর্ম আগমনের পূর্বে কেলটিক আয়ারল্যান্ডের প্রধান দেবী ছিলেন ব্রিজিড। যখন আয়ারল্যান্ড খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হয়, দেবী ব্রিজিডকেও ব্যাপটাইজড করা হয়েছিলো, তিনি হয়ে ওঠেন সেইন্ট ব্রিজিড, যিনি আজো ক্যাথলিক আয়ারল্যান্ডে সবচেয়ে সম্মানিত সেইন্ট।

বহু-ইশ্বরবাদ শুধু একেশ্বরবাদী ধর্মেরই জন্ম দেয় নি, দ্বৈতবাদী ধর্মেরও জন্ম দিয়েছে। দ্বৈতবাদী ধর্মগুলি দুইটি বিপরীতধর্মী অস্তিত্বকে স্বীকার করেঃ ভালো এবং মন্দ। দ্বৈতবাদ ব্যাখ্যা করে যে সমগ্র মহাবিশ্ব হলো এই দুই শক্তির লড়াই এর একটি ময়দান, আর বিশ্বে যা ঘটে তার প্রতিটিই হচ্ছে এই সংগ্রামের অংশ।

একেশ্বরবাদ ব্যাখ্যা করতে পারে না দোষশূন্য শুভ ইশ্বর থাকতেও পৃথিবীতে এত দুর্দশা কেন। আবার দ্বৈতবাদ ব্যাখ্যা করতে পারে না যদি ভালো ও মন্দের যুদ্ধ হয়, তাহলে এই যুদ্ধের নিয়ম কে পরিচালনা করবেন? যেমন ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম একই থাকে। এই যুদ্ধে কোন জগতের নিয়ম খাটবে? দুই মতবাদের অপূর্ণতা এড়াতে চাইলে যেটা দাঁড়ায়, একটিমাত্র সর্বশক্তিমান ইশ্বর আছেন, যিনি এই সমগ্র মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন, তিনিই সেই অশুভ শক্তি। কিন্তু এই ধরনের বিশ্বাস হজম করার মত পৃথিবীতে কেউ নেই৷ কয়েকটি বিখ্যাত দ্বৈতবাদী মতবাদ হলো - Zoroastrianism, Gnosticism, Manichaeanism.

তৃতীয় ও চতুর্থ শতাব্দীর সময়ে ম্যানিকিয়ান ধর্ম চীন থেকে উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিলো, এবং রোমান সাম্রাজ্য ও খ্রিষ্টধর্মকে হুমকির মুখে ফেলেছিলো। তবুও ম্যানিকিয়ানরা রোমানদের খ্রিষ্টধর্মের কাছে পরাজিত হয় আর একেশ্বরবাদী মুসলিমদের কাছে জোরাষ্ট্রিয়ানরা পরাজিত হয়৷ দ্বৈতবাদী তরঙ্গের সমাপ্তি ঘটে।

 কিছু ধর্ম মনে করে, বিশ্বের পরিচালনা কারো ঐশ্বরিক ইচ্ছা ও খেয়াল খুশি না, বরং প্রকৃতির নিয়মের ফলাফল। দেবতাদের অস্তিত্ব সমর্থন করলেও তারাও ছিলো মানুষের মতই প্রকৃতির নিয়মের অধীন। এমন একটি ধর্ম হলো বৌদ্ধ ধর্ম৷ এর কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব কোন ইশ্বর নন, একজন মানুষ, গৌতম বুদ্ধ, যিনি হিমালয়ের একটি ছোট রাজ্যে ৫০০ BC এর কোন সময়ে জন্মেছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেন দুঃখ কষ্ট কোন দুর্ভাগ্য বা ঐশ্বরিক খেয়ালের কারণে নয়, নিজের মনের আচরণের ধরণে হয়৷ ইশ্বরে বিশ্বাস তাদের কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ। তারা অস্বীকার করে না যে তাদের দেবতারা বৃষ্টি নামাতে পারে বা যুদ্ধে জয়লাভ করাতে পারে। কিন্তু দেবতাদের সেই নিয়মের উপর প্রভাব নেই যেই নিয়মের কারণে আকাঙ্ক্ষা থেকে দুর্দশার সৃষ্টি হয়। তবে এটাও সত্য, ৯৯% বৌদ্ধই নির্বাণ লাভ করে নি, পার্থিব জীবনে সাফল্য অর্জনেই তারা সময় ব্যয় করে।

গত ৩০০ বছরের ইতিহাসে প্রায়ই এটিকে ধর্মনিরপেক্ষতার শুরুর যুগ হিসেবে দেখা হয়৷ ঐশ্বরিক নিয়মে বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা একদল মানুষের বিশ্বাসকে যদি ধর্ম বলা হয়, তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়নের কম্যুনিজমও ইসলাম ধর্মের চেয়ে কোন অংশে কম ছিলো না। অবশ্যই ইসলাম সর্বশক্তিমান সৃষ্টাকে বিশ্বাস করলেও কম্যুনিজম দেবতাতে বিশ্বাস করতো না৷ কিন্তু ইসলাম ধর্ম যেমন প্রচারমুখী, কমিউনিষ্টদের কাছেও আশা করা হত যে সে জীবনের বিনিময়ে হলেও মার্ক্স ও লেনিনের গসপেল ছড়িয়ে দেবে।

মানবতাবাদী ধর্মগুলি মানবতা, আরো সঠিকভাবে বললে হোমো সেপিয়েন্সের পূজা করে৷ এর লক্ষ্যই হলো হোমো স্যাপিয়েন্স এর কল্যাণ, যেন অন্য সকল প্রাণীসহ বিশ্বের বাকি অংশ যেন এই প্রজাতির জন্যই বিদ্যমান। মানবতাবাদ তিনটি প্রতিদন্দ্বী অংশে বিভক্ত। উদারনৈতিক মানবতাবাদ ( Liberal humanism) এর মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যা মনে করে প্রত্যেক ব্যক্তির স্বাধীনতা পবিত্র এবং এখান থেকেই মানবাধিকারের জন্ম। শেক্সপিয়ার এবং মোলিয়ের যুগে ভীতিকর মৃত্যুদন্ড ছিলো লন্ডন ও প্যারিসবাসীর জন্য একটি প্রিয় অবসরযাপন যা আজকে মানবতার একটি পবিত্র বৈশিষ্ট্যের লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷ আরেকটি অংশ হলো সমাজতান্ত্রিক মানবতাবাদ যা ব্যক্ত করে, বৈষম্য হলো মানবতার বিরুদ্ধে করা সবচেয়ে নিকৃষ্ট অপরাধ। উদারনৈতিক মানবতাবাদ এবং সমাজতান্ত্রিক মানবতাবাদ উভয়ই একেশ্বরবাদী বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। কেবল যে মানবতাবাদী অংশ একেশ্বরবাদ থেকে মুক্ত তা হলো বিবর্তনীয় মানবতাবাদ যার বিখ্যাত প্রতিনিধি হলো নাৎসি। নাৎসিরা মনে করতো মানবজাতি কোন সর্বজনীন ও শাশ্বত কিছু নয়, বরং পরিবর্তনশীল প্রজাতি যা সুপারম্যান হতে পারে বা অধঃপতিত হয়ে সাবহিউম্যানও হতে পারে। এই দোহাই দিয়ে নাৎসিরা নিজেদের আর্য এবং ইহুদীদের নিম্ন শ্রেণী মনে করতো এবং তাদের সাথে নিজেদের মিশ্রণকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধঃপতনের কারণ হতে পারে বলে ধারণা করতো। এর দোহাই দিয়ে তারা ৬ মিলিয়ন ইহুদী হত্যা করেছিলো। জীববিজ্ঞানীরা পরে প্রমাণ করেছে মানুষের বিভিন্ন বংশের মাঝে জেনেটিক্যাল পার্থক্য নাৎসিদের দাবির তুলনায় অনেক কম। তবে ১৯৩৩ সালের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান সীমিত থাকায় নাৎসিদের বিশ্বাস একদম বাতিল করে দেওয়া যেত না।

তবে বিবর্তনবাদী মানবাতবাদেরও উদ্দেশ্য ছিলো মানবকল্যাণ, নাৎসিরা মানবজাতিকে ঘৃণা করতো না, তারা অপজাতির দূষণ রোধ করে মানবকল্যাণ করতে চেয়েছিলো। বরং উদারনীতি ও সাম্যবাদী মানবতাবাদ দুর্বলদের বেচে থাকার সুযোগ দিয়ে প্রাকৃতিক নির্বাচন নিম্নমুখী করেছে।

 

The Secret of Success

আমরা এখন আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভবিষ্যৎবাণী না করতে পারলেও কয়েক শতাব্দী পরের মানুষ পিছনে তাকালে উপলব্ধি করবে জবাবগুলো ছিলো কতটা স্পষ্ট। কনস্ট্যান্টিন ৩০৬ সালে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার সময় খ্রিষ্টধর্ম এত বিকশিত ছিলো না, কেউ যদি বলতো এটা রোমানদের রাষ্ট্রধর্ম হতে যাচ্ছে তবে হাসির খোরাক হতে হতো। ১৯১৩ সালে কেউ বলতে পারতো না বলশেভিকের মত ছোট রুশ দল ক্ষমতায় যাবে। বাইজেন্টাইন সেনাবাহিনী প্রাথমিক আক্রমণ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হলে ইসলাম আজকে অতি অল্প স্কলারের জানা অখ্যাত ধর্ম হিসেবে রয়ে যেত। ইতিহাসের গতিপথ সুনির্দিষ্ট নয় এবং এটি মেনে নেওয়ার মানে হলো বেশিরভাগ মানুষ যে জাতীয়তাবাদ, পুঁজিবাদ ও মানবাধিকারে বিশ্বাস করে তা সম্পূর্ণই কাকতালীয় ঘটনা। ইতিহাস হলো একটি লেভেল টু বিশৃঙ্খলা সিস্টেম। লেভেল ওয়ান সিস্টেম হলো আবহাওয়া, আবহাওয়ার পূর্বাভাস আবহাওয়াকে প্রভাবিত করে না। লেভেল টু সিস্টেম হলো যেই সিস্টেমে পূর্বাভাস ফলাফলকে প্রভাবিত করে। যেমন এমন কম্পিউটার সফটওয়্যার যদি ডেভেলপ করা যায় যা তেলের দাম অনুমান করতে পারবে, এবং সবাই যদি সেটা পায়, এবং সবাই যদি জানতে পারে তেলের দাম বর্তমানে কম, চাহিদা বেড়ে যাবে। ফলে দাম বেড়ে যাবে। অর্থাৎ অনুমান বা পূর্বাভাস ফলাফল বা দামকে প্রভাবিত করছে। ইতিহাস যেহেতু লেভেল টু সিস্টেম, তাই ইতিহাস কখনো ভবিষ্যদ্বাণী করার উপায় নয়। তবে ইতিহাস কেন পড়া উচিত? এটা বুঝার জন্য যে আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি অনিবার্য নয় এবং সামনে অনেক সম্ভাবনা কল্পনা করতে পারি।

ইতিহাসের চয়েস মানুষের উপকারের জন্য হয় না। খ্রিষ্টানরা মনে করে মানিকিয়াবাদের উপর খ্রিষ্টধর্মের বিজয় মানুষের জন্য কল্যাণকর ছিলো। মুসলিমরা মনে করে সাসানিড সাম্রাজের পতন মানবজাতির জন্য হিতকর ছিলো। বাস্তবতা হলো সংস্কৃতি একটি পরজীবী এবং আর মানুষ এই পরজীবীর নির্বোধ পোষক। মানুষ মরে যায়, কিন্তু আইডিয়া ছড়িয়ে পড়ে। এটিকে মেমেটিকস ও বলা হয়। সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ভিত্তি নির্ভর করে সাংস্কৃতিক তথ্য এককের উপর যাকে বলা হয় 'মিম'। সেগুলোই সফল সংস্কৃতি যেগুলো মিমগুলির পুনরুৎপাদনে সফল হয়, বাকিগুলি হারিয়ে যায়। পোষ্টমডার্নিস্টরা মিমকে সংস্কৃতির মূল উপাদান মেনে না নিলেও এটিকে নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী। তারা জাতীয়তাবাদকে একটি মহামারী হিসেবে দেখেন এবং যুদ্ধ, নিপীড়ণ, ঘৃণা ও গণহত্যার জন্য দায়ী মনে করেন। জাতীয়তাবাদী ভাইরাস মানুষের জন্য উপকারী হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছিলো, তবে এটি মূলত নিজেরই উপকার করেছে৷ পাকিস্তান অস্ত্র কিনলে ভারতও অস্ত্র কিনবে, পাকিস্তান নৌবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করলে ভারতও করবে। এভাবে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়ে যাবে যা তারা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করতে পারতো। এই ধরনের অস্ত্র প্রতিযোগিতার গতি প্রতিরোধ করা কঠিন। এর বিস্তার হচ্ছে একটি শক্তিশালী গতির অনিচ্ছাকৃত ফল।

 গেম থিওরি, পোস্ট মডার্নিজম বা মেমেটিক্স যাই বলুন না কেন, ইতিহাসের গতিপথ মানুষের কল্যাণের দিকে নির্দেশিত নয়। ইতিহাসের অধিকাংশ সফল সংস্কৃতি হোমো সেপিয়েন্সের জন্য খুবই মঙ্গলজনক তা মনে করার কোন ভিত্তি নেই। বিবর্তনের মত, ইতিহাস পৃথক কোন জীবের সুখ বিবেচনা করে না। আর মানুষরাও পৃথকভাবে ইতিহাসের যাত্রাপথ থেকে নিজেদের সুবিধামত এগিয়ে যাবার মত বিজ্ঞ নয়।





Popular Posts