Sapiens Synopsis E01: The Cognitive Revolution


An Animal of No Significance

২৫ লক্ষ বছর পূর্বে প্রথম কোন হোমো গণের সদস্যের উদ্ভব ঘটে পূর্ব আফ্রিকায়। ২০ লক্ষ বছর পূর্বে তারা মাতৃভূমি থেকে আফ্রিকা, ইউরোপ এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পরে৷ এখন, বিভিন্ন অঞ্চলের জলবায়ু ভিন্ন, যেমন : উত্তর ইউরোপের তুষারময় জঙ্গল এবং ইন্দোনেশিয়ার উষ্ণ জঙ্গলের জলবায়ুর ভিন্নতা আছে। ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে মানিয়ে নিতে মানবজাতি ভিন্ন ভিন্ন ভাবে অভিযোজিত হয় এবং তাদের বিবর্তনের রাস্তা পৃথক হয়ে যায় অঞ্চলভেদে। ফলে স্বতন্ত্র মানব প্রজাতি প্রকট হয়। নিচে এলাকাভেদে কিছু প্রজাতি হলোঃ

Homo rudolfensis - East Africa
Homo erectus - East Asia

Homo neanderthalensis - Europe and western Asia
Homo soloensis - Java Island, Indonesia
এবং এরা প্রত্যেকেই মানব প্রজাতি (বানর বা উল্লুক না, মানব প্রজাতি)

Note: বইতে আমাদের প্রজাতি অর্থাৎ হোমো স্যাপিয়েন্সকে স্যাপিয়েন্স বলা হয়েছে এবং হোমো স্যাপিয়েন্স, হোমো রুডলফেনসিস, হোমো ইরেক্টাস ইত্যাদি সবাইকে অর্থাৎ হোমো গণের সবাইকে বলা হয়েছে মানবজাতি বা মানবগোষ্ঠী।


ফ্লোরেসের বিবর্তনঃ

ইন্দোনেশিয়ার ফ্লোরেস দ্বীপপুঞ্জে যখন মানবজাতি পৌছায় তখন সমুদ্রপৃষ্ঠ অনেক নিচু ছিলো। এরপর সমুদ্রপৃষ্ঠ উপরে উঠে যায়, সেখানে যাওয়া মানবজাতি আটকা পরে। আটকা পরা মানবজাতির তুলনায় খাবার ছিলো অতি কম, তাই যাদের আকার ছিলো বড় এবং খাদ্য চাহিদা ছিলো বেশি, তারা আগে মারা পরলো এবং ছোট আকারের মানবসদস্যরা টিকে গেলো, এবং তারা এমনভাবে বিবর্তিত হতে থাকলো যেন কম খাবারেই টিকে থাকতে পারে। ফলে তাদের উচ্চতা হয় মাত্র ৩'৩" এর মত (আমাদের ৫'৫") আর ওজন দাঁড়ায় ২০-২৫ কেজি।

আমাদের মাঝে একটা ভুল ধারণা হলো যে বিবর্তন সরলরৈখিক, এরগেষ্টার থেকে উদ্ভুত হয়েছে ইরেক্টাস, সেখান থেকে নিয়েন্ডার্থাল এবং নিয়েন্ডার্থাল থেকে স্যাপিয়েন্স৷ এবং একটা সময় একটা প্রজাতিই বাস করতো। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।

প্রকৃতপক্ষে, বিবর্তন হলো গাছের মত যার সকল ডাল বিকশিত নাও হতে পারে, বিলীন হয়ে যেতে পারে। ২০ লক্ষ বছর আগ থেকে ১০ হাজার বছর আগ পর্যন্ত হোমো গণের একাধিক প্রজাতি বাস করতো যাদের নাম উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। বরং আমরা একটা বোরিং সময়ে বাস করছি কারণ আমাদের সময় আমরা হোমো স্যাপিয়েন্স অনন্য, আর কোন মানব প্রজাতি নেই। টাইম মেশিনের মাধ্যমে দশ হাজার বছরের আগে গেলে আমাদের আরো মানব প্রজাতির সাথেই বসবাস করতে হতো। আর বর্তমান সময়ে আমরা কেন একাই বাস করছি, এটারও কারণ আছে। পরবর্তীতে বলবো।

 মানব মস্তিষ্কের উৎকর্ষঃ

বৃহৎ মস্তিষ্ক মানেই বুদ্ধিমত্তা বেশি নয়। তাহলে বিড়ালের মস্তিষ্কের যে সাইজ তা দিয়ে ক্যালকুলাস করা যেত। তিমি হতো সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী। তবে বিবর্তনের ধারায় মানব মস্তিষ্ক বড় হয়েছে সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। এরজন্য মানুষকে মূল্য দিতে হয়েছে। ভারী মস্তিষ্কের বোঝা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে, এবং প্রচুর জ্বালানি খরচ করে। ওজনে ২-৩ শতাংশ হলেও বিশ্রামের সময়ও ২৫ শতাংশ জ্বালানি খরচ করে। যেখানে এপদের খরচ হয় ৮ শতাংশ। এরজন্য খাদ্যের সন্ধানে অধিক সময় ব্যয় করা লেগেছিলো। এবং মস্তিষ্কের উপর জোর দেওয়ায় পেশী ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে গিয়েছিলো।

কিন্তু আমাদের মস্তিষ্ক আজ চমৎকারভাবে এই মূল্য পরিশোধ করছে। এখন আমরা গাড়ি বানিয়ে সব প্রাণীর চেয়ে দ্রুত যেতে পারি এবং বন্দুক ব্যবহার করে সব প্রাণীর উপর রাজত্ব করতে পারি। কিন্তু সেটা বর্তমান সময়ের কথা। ২০ লক্ষ বছর ধরে মানব প্রজাতির নিউরাল নেটওয়ার্কগুলি উন্নত হতে থাকলেও পাথুরে ছুরি আর চোখা লাঠি ছাড়া তেমন কিছু বানাতে পারে নি৷ আমাদের প্রচুর ধৈর্য্য ধরতে হয়েছে। মাত্র চার লক্ষ বছর পূর্বে আমরা বড় বড় প্রাণী শিকার করা শিখি। তবে এক লক্ষ বছর আগে হোমো স্যাপিয়েন্সের উত্থানের ফলে অতি দ্রুত তাড়া খাদ্য শিকলের চূড়ায় চলে আসে৷

পাশাপাশি বাস করা প্রজাতিগুলো পরস্পরের সম্পর্ক অনুযায়ী বিবর্তিত হয়। সিংহ আরো প্রাণনাশক হলে হরিণও সাথে আরো দ্রুত হয় বিবর্তনের সাথে। কিন্তু মানব প্রজাতি হঠাৎ মন্থর সময় অতিক্রম করার পর এত দ্রুত উপরে উঠে আসে যে পরিবেশ তার ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য সমন্বয় করার সময় পায় নি। এখনকার মত স্যাপিয়েন্স উত্থান থেকেই পরাক্রমশীল ছিলো, এমন নয়। অন্যান্য মানব প্রজাতি যখন লক্ষ্য বছর আধিপত্যের জন্য আত্মবিশ্বাসী ছিলো, তখন আমরা ছিলাম উষ্ণমন্ডলীয় অঞ্চলের ভীতু উদ্বিগ্ন প্রাণী, যা পরবর্তীতে আমাদের দ্বিগুণ নিষ্ঠুর ও সহিংস করে তোলে৷

কেন মানবশিশু অন্য প্রাণীদের শিশুদের থেকে অসহায়?

আমরা আরেকটি বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছিলাম। সেটা হলো সোজা হয়ে দাড়ানো। উষ্ণমন্ডলীয় বৃক্ষহীন তৃণভূমিতে শত্রুর উপর উচু হয়ে উকি মেরে নজর রাখতে রাখতে বিবর্তনের ধারায় আমরা সোজা হয়ে দাঁড়াই। কিন্তু এই সোজা হয়ে দাঁড়ানোর খেসারত হলো আধুনিক ঘাড় ও পিঠব্যাথা৷


এখন এখানে একটা বিপত্তি ঘটে। সোজা হয়ে দাড়ানোর জন্য নারীদের যোনিপথ সংকুচিত হয় কিন্তু তখন মানুষের মস্তিষ্ক তথা মাথার আকার বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। তাই সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় মায়ের মৃত্যুহার বৃদ্ধি পেয়েছিলো। তাই বিবর্তনের ধারায় মানুষ অপূর্ণাঙ্গ বাচ্চা দেওয়া শুরু করলো। এইজন্যই এখন ঘোড়ার বাচ্চা জন্মের পরেই চলতে পারে কিন্তু মানবশিশু অসহায়, খাদ্য, সুরক্ষা এবং শিক্ষার পিছে বহু বছর অপেক্ষা করতে হয়৷ কিন্তু এই অসহায়ত্ব আমাদের জন্য ট্রাম্প কার্ড, এর জন্যই আমরা একটা বাচ্চাকে ছোট থেকে খ্রিষ্টান বা বৌদ্ধ, পুঁজিবাদী বা সমাজতন্ত্রী যে কোন দীক্ষায় দীক্ষিত করতে পারি। মানবশিশুর এই অসহায়ত্ব আমাদের সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধি করেছে।

আগুনের ব্যবহারঃ

কোন কোন মানব প্রজাতি আট লক্ষ বছর পূর্বে আগুন ব্যবহার করলেও হোমো স্যাপিয়েন্সের পূর্ব পুরুষরা, নিয়েন্ডার্থাল, ইরেক্টাসরা নিয়মিত আগুন ব্যবহার করতো তিন লাখ বছর আগে। এর ফলে মানবজাতি সিংহদের বিরুদ্ধে একটি ব্রহ্মাস্ত্র পায়, এবং তারা শারীরিক শক্তিকে অতিক্রম করে। একজন দুর্বল মহিলা কয়েক ঘন্টায় পরিকল্পিতভাবে আশপাশের বিশাল জঙ্গল পুড়িয়ে তৃণভূমিতে পরিণত করে ফেলতে পারতো। সবচেয়ে লাভ হলো রান্নায়, আগে কাচা খাবার চিবিয়ে চিবিয়ে খেতে ৫-৬ ঘন্টা লাগলো, এখন রান্নার জন্য এক ঘন্টা খেলেই চলে।


সেপিয়েন্স এবং নিয়েন্ডার্থালদের সহাবস্থানঃ

৭০ হাজার বছর পূর্বে স্যাপিয়েন্সরা আফ্রিকা থেকে আরব ও পুরো ইউরেশিয়ায় ছড়িয়ে পরে। হোমো স্যাপিয়েন্সরা তখন নিয়েন্ডার্থালদের মুখোমুখী হলো। আমরা নিয়েন্ডের্থালসদের নিষ্ঠুর ও নির্বোধ গুহাবাসী মানব মনে করলেও বর্তমান গবেষণা বলে তারা স্যাপিয়েন্সদের থেকে পেশীবহুল, বৃহৎ মস্তিষ্কের অধিকারী ছিলো এবং ঠান্ডা আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নিয়েছিলো। প্রত্নতত্ববিদরা নিয়েন্ডার্থালদের এমন কঙ্কাল পেয়েছেন যা শারীরিক অক্ষমতা নিয়েও বহুবছর বেঁচে ছিলো, মানে স্বজনের সেবা পেয়েছিলো দুর্বলরা।

স্যাপিয়েন্স এবং নিয়েন্ডার্থালদের সহাবস্থান নিয়ে দুটি তত্ত্ব আছে৷ সংকর প্রজনন ত্তত্ব অনুযায়ী নিয়েন্ডার্থাল এবং স্যাপিয়েন্সদের মাঝে মিলন ঘটে৷ তার মানে ইউরেশীয়রা পুরো স্যাপিয়েন্স না, নিয়েন্ডার্থালদের জিন আছে তাদের দেহে। প্রতিস্থাপন তত্ত্ব অনুযায়ী কোন মিলন ঘটে না পরস্পরের মাঝে, মানে আমরা বিশুদ্ধ স্যাপিয়েন্স।

বিজ্ঞানীরা এই বর্ণবাদের প্যান্ডোরার বাক্স খুলতে চাননি কারণ সংকর প্রজনন তত্ত্ব একটা রাজনৈতিক ডিনামাইট, বর্ণবাদী তত্ত্বসমূহের জ্বালানি হিসেবে কাজ করতে পারে। কিন্তু ২০১০ সালে নিয়েন্ডার্থালদের জিনোম ম্যাপ প্রকাশিত হলে দেখা যায় মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপীয়দের ১-৪% স্বকীয় DNA নিয়েন্ডার্থাল DNA. এটি ভাবতেই অস্বস্তিকর এবং হয়তো রোমাঞ্চকর যে এককালে আমরা সেপিয়েন্সরাও ভিন্ন একটি প্রজাতির সাথে মিলিত হতে এবং সন্তান উৎপন্ন করতে পারতাম।

নিয়েন্ডের্থালরা কিভাবে বিলুপ্ত হয়েছে, তা ইতিহাসের পাতায় বিরাট এক প্রশ্নচিহ্ন। হয়তো স্যাপিয়েন্সদের জ্যামিতিক বৃদ্ধিতে নিয়েন্ডার্থালরা খাদ্য সংকটে পরে যায়, বা আমরা সেপিয়েন্সরা তাদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলি। বর্তমানকালে সামান্য চামড়ার রং এর পার্থক্য বা ধর্মীয় মতবাদের পার্থক্য স্যাপিয়েন্সের একটি গোষ্ঠীকে নির্মূলের উদ্দীপনা হিসেবে যথেষ্ঠ। সেখানে কি সেপিয়েন্সরা নিয়েন্ডের্থালদের মত আস্ত ভিন্ন একটা প্রজাতিকে মেনে নিয়েছিলো?

 যাই হোক, Homo soloensis রা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ৫০০০০ বছর আগে। নিয়েন্ডেরথেলরা চলে যায় ৩০০০০ বছর আগে। ফ্লোরেন্সের খর্বাকায় মানুষরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ১২ হাজার বছর আগে। হোমো ইরেক্টাসরা যেখানে ২০ লক্ষ বছর টিকে ছিলো, আমরা সেপিয়েন্সরা সেখানে দশ হাজার বছরের মাঝেই অস্তিত্ব সংকটের হুমকির মুখে। সবচেয়ে বুদ্ধিমান সেপিয়েন্স হিসেবে তবে আমরা কতটুকু সার্থক?

The Tree of Knowledge

সেপিয়েন্সরা দেড় লক্ষ বছর পূর্ব থেকেই পূর্ব আফ্রিকায় বসবাস করছিলো৷ পূর্বের এপিসোডে আমরা দেখেছি হোমো স্যাপিয়েন্সরা নিয়েন্ডার্থালদের মুখোমুখি হয় যখন তারা পূর্ব আফ্রিকা থেকে ছড়িয়ে পরে ইউরেশিয়া এবং আরবে। বস্তুত, সেপিয়েন্স এবং নিয়েন্ডার্থালদের মধ্যে প্রথম সংঘাতে নিয়েন্ডার্থালরা বিজয়ী হয়। তবে আমরা যদি টাইমলাইনে আরেকটু এগিয়ে আসি, ৭০ হাজার বছর আগে সেপিয়েন্সরা এমন পরাক্রমশালী হয়ে উঠে যে অন্য সব মানব প্রজাতিকে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দেয়। কিন্তু ৭০ হাজার বছর আগে হঠাৎ কি এমন হলো যে তারা এমন পরাক্রমশালী হয়ে উঠেছিলো? দ্বিতীয়বারের মত আফ্রিকা ছেড়ে বেরিয়ে পরেছিলো? ৪৫ হাজার বছর পূর্বে তারা সাগর পাড়ি দিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে গিয়ে গিয়েছিলো, যেখানে এর পূর্বে অন্য কোন মানবজাতির পদচিহ্ন পরে নি৷ ৭০ হাজার থেকে ৩০ হাজার বছর আগের সময়ের মাঝে তারা নৌকা, তেলের প্রদীপ, তীর ধনুক, সূচ উদ্ভাবন করেছিলো। ৩০ হাজার বছর আগে যে মানব সদস্য স্টেইডলের সিংহ-মানব খোদাই করেছিলো, তার শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত যোগ্যতা ছিলো আমাদের মতোই। হঠাৎ এই বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের কারণ কি?

সবচেয়ে প্রচলিত তত্ত্ব হলো আকস্মিক জেনেটিক মিউটেশন সেপিয়েন্সের মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটায় যা অভূতপূর্ব পন্থায় চিন্তা করতে সক্ষম হয় এবং পুরোপুরি নতুন ধরনের ভাষা ব্যবহার করে ভাব বিনিময়ের সক্ষমতা লাভ করে৷ এখন প্রশ্ন হলো এই মিউটেশন সেপিয়েন্সদের DNA তেই কেন হলো, নিয়েন্ডার্থালদের কেন নয়? কারণ mutation হলো random আকস্মিক ঘটনা, বাকি মানবজাতিরও হবে এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। তবে এই মিউটেশনের কারণের চেয়ে ফলাফলটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের পর আমাদের ভাষা হয়ে উঠলো বিস্ময়করভাবে নমনীয়৷ সীমিত শব্দ ব্যবহার করে আমরা অসীম সংখ্যক বাক্য গঠন করতে পারতাম। ভাষার প্রাথমিক ব্যবহার সিংহ এবং বাইসনের অবস্থান,সংখ্যা এইসব তথ্য আদান প্রদানের জন্য ব্যবহার করা হলেও অতি দ্রুত তা পরচর্চার মাধ্যম হয়ে উঠে। গোষ্ঠীর কে কাকে ঘৃণা করে, কে কার সাথে ঘুমায়, কে সৎ ও কে প্রতারক এইসব জানার জন্য ভাষার ব্যবহার শুরু হয় এবং আমরা আরো সামাজিক হয়ে উঠি৷ এই পরচর্চা আমাদের আরো সুরক্ষিত করে কারণ পরচর্চা মূলত অপরাধমূলক বিষয়ের উপর হয় এবং সমাজের সদস্যদের সতর্ক রাখে।

জার্মানির স্টেইডেল গুহায় হাতির দাঁতের তৈরী সিংহ মানবের ( বা সিংহ মানবীর) মূর্তি পাওয়া যায় যার মাথা সিংহের কিন্তু দেহ মানবের। মূর্তিটা ৩২০০০ বছরের পুরনো৷ এর মানে ওই সময় স্যাপিয়েন্স এমন কিছু কল্পনা করতে পারতো যেটার বাস্তবে অস্তিত্ব নেই। অতি সাধারণ মনে হলেও এটা একটা বিশাল ব্যাপার। বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব আমাদের abstract কিছু কল্পনা করার সুযোগ দেয়। তো অবাস্তব ঘটনা বা মিথ কল্পনা করে আমাদের লাভ কি হলো? ১৯২০ এর কোন সায়েন্স ফিকশনই ২০২০ এর বর্তমান সময়কে নিখুতভাবে দেখাতে পারে নি, যারা বনে পরী আর ইউনিকর্ন খুজে বেড়াবে, তাদের টিকে থাকার সম্ভাবনা কম আর যারা হরিণ আর ফলের খোজ করবে তাদের টিকে থাকার সম্ভাবনা বেশি৷ তো লাভ কি হলো? বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের পর আমরা যে পরচর্চা শিখলাম সেটা নেটওয়ার্ক তৈরীর জন্য যথেষ্ঠ নয়। পরচর্চা বা গসিপ সর্বোচ্চ দেড়শোজনের উপর করা যায়, কিন্তু এর উপর চলে গেলে ভেঙ্গে পরে। চিন্তা করে দেখুন আপনি আপনার জীবনে কতজনের সাথেই বা গসিপ করেছেন। তাহলে হাজার সৈন্যের প্ল্যাটুন বা কোটি মানুষের সাম্রাজ্য কিভাবে পরিচালিত হবে? এইখানে আমাদের কাজে আসলো মিথ তৈরী ও বিশ্বাস করার ক্ষমতা।


এক লাখ বছর পূর্বে একজন মানব সদস্য আরেকজন অপরিচিত মানব সদস্যকে সাহায্য করার সম্ভাবনা কম, কারণ ছাড়া কেউ সাহায্য করে না। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র, মধ্যযুগীয় গীর্জা, প্রাচীন শহর এইসব গড়ে উঠেছে মিথ এর উপর ভিত্তি করে। দুইজন ক্যাথলিক একে অপরের সাথে পূর্ব পরিচয় ছাড়াই ক্রুসেডে যোগ দিতে পারে কারণ তারা একই বিমূর্ত বিষয় বিশ্বাস করে। জুডিসশিয়াল সিস্টেম দাড়িয়ে আছে প্রচলিত বৈধ মিথ এর উপর। আদিমরা ভূত আত্মায় বিশ্বাসের মাধ্যমে তাদের সামাজিক শৃঙ্খলা দৃঢ় করেছিলো। Peugeot নামে গাড়ির কোম্পানি বা যে কোন কোম্পানির কথা চিন্তা করুন। সব গাড়ি ধ্বংস হয়ে গেলেও, সব কর্মী মারা গেলেও Peugeot ধ্বংস হবে না। কিন্তু কোন বিচারক যদি কোম্পানিটির লাইসেন্স বাতিল করে দেয় বা ভেঙ্গে দেয়ার রায় দেন, কোটি টাকার ক্যাপিটাল, লক্ষ কর্মী, শত কারখানা থাকলেও তা বিলীন হয়ে যাবে। অর্থাৎ, Peugeot হলো একটা অলীক উদ্ভাবন, আইনজীবীরা এটাকে 'বৈধ কল্পকাহিনি' বলে অভিহিত করেন। এর উপর ভিত্তি করে লক্ষ লক্ষ কর্মী, কোটি কোটি ক্রেতা মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত হয়। আধুনিক 'Limited Liability Company' গুলোও myth এর ভিত্তি করেই গড়ে উঠা। Private Limited Company গুলো দেনাগ্রস্থ হলে ব্যাক্তি সম্পদ ক্রোকড হবে, প্রাচীনকালে ব্যক্তির সন্তানদের আজীবন দাস খাটতে হতো কিন্তু Limited Liability Company তে প্রতিষ্ঠাতা ঋণদাতার কাছে এক টাকাও দায়ী থাকে না।

অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, পুঁজিবাদ, আইন এইসব abstract কিছু কল্পনা করতে পারি বলেই আমরা এত নমনীয়ভাবে সামাজিক হয়েছি এবং পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছি। বিশ্বাস ছাড়া বাণিজ্যের অস্তিত্ব থাকতে পারে না, আর একজন আগন্তুককে বিশ্বাস করা কঠিন। এইজন্য আমরা আশ্রয় নিই ডলার, ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক এইসবের উপর যার সবই ভার্চুয়াল। যখন কোন উপজাতীয় সমাজে দুইজন অপরিচিত ব্যক্তি বাণিজ্য করতে চাইত, তারা প্রায়ই তাদের এক অভিন্ন ইশ্বর, পৌরাণিক পূর্বপুরুষ অথবা টোটেম প্রাণীর কাছে আবেদনের মাধ্যমে বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করতো।

একজন মানুষ লক্ষ লক্ষ মানুষকে ইশ্বর বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয় কারণ মানুষ অলীককে কল্পনা করতে পারে। ২০১১ সালে জাতিসংঘ লিবিয়ার জনগণের মানবাধিকারের প্রতি সম্মান জানানোর আহবান জানিয়েছিলো। জাতিসংঘ, লিবিয়া, মানবাধিকার সবই আমাদের উর্বর মস্তিষ্কের অলীক উদ্ভাবন। একটি আধুনিক নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড তৈরীর জন্য প্রয়োজন সারা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ পরিচিত ব্যক্তির সহযোগিতা, ইউরেনিয়াম উত্তোলনকারী শ্রমিক থেকে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ পর্যন্ত। এই পুরো ব্যবস্থা নির্ভর করে অসংখ্য abstract parameter উপর। Cognitive Revolution এর পর থেকেই সেপিয়েন্সরা দ্বৈত বাস্তবতা নিয়ে বসবাস করতে থাকে। একদিকে গাছ, নদী, সিংহের মত বাস্তবতা অন্যদিকে ইশ্বর, জাতি, কর্পোরেশনের কল্পিত বাস্তবতা।

তবে এই মিথ পরিবর্তিত হয়ে বিপ্লব বয়ে আনতে পারে।প্রাচীনকালে জেনেটিক মিউটেশন ছাড়া বিপ্লব হতো না। ২০ লক্ষ বছর আগে জেনেটিক পরিবর্তনের ফলে হোমো ইরেক্টাসের উদ্ভব ঘটে। এরপর ২০ লক্ষ বছর ধরে তাদের কোন জেনেটিক পরিবর্তন ঘটে নি, তাই তাদের পাথরের হাতিয়ার মোটামুটি একই রকম রয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের পর জেনেটিক পরিবর্তন ছাড়াই বড় বড় বিপ্লব ঘটেছে কারণ মিথের বিশ্বাসের পরিবর্তনই বড় বিপ্লব ঘটাতে পারে। যেমন,১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লব হয় যখন রাজার ঐশ্বরিক অধিকারের মিথের বিশ্বাস জনগণের স্বাধীনতা মিথের বিশ্বাসে পরিণত হয়৷ শিম্পাঞ্জীদের আলফা পুরুষ সর্বোচ্চ যৌনাধিকার পেলেও ক্যাথলিক আলফা পুরুষ সঙ্গম থেকে বিরত থাকে, যদিও তার এইরকম করার কোন জেনেটিক বা পরিবেশগত কারণ নেই।

A Day in the Life of Adam and Eve


বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের শাখা থেকে আমরা জানতে পেরেছি আমাদের যে ধরনের সামাজিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, সেগুলো তৈরী হয়েছিলো কৃষিপূর্ব যুগে। যেমন প্রস্তরযুগে যদি কেউ ডুমুর গাছের দেখা পেত, তৎক্ষণাৎ যতটা সম্ভব খেয়ে নিতো স্থানীয় বেবুন দল গাছটিকে ফলশূন্য করার আগেই। উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাদ্যের গুরুভোজ আমাদের জিনে স্থায়ীভাবে মুদ্রিত হয়ে আছে। তাই, এখন আমরা বহুতলে এপার্টমেন্টে বড় সাইজের রেফ্রিজারেটরসহ বাস করলেও আমাদের DNA মনে করে আমরা বৃক্ষহীন তৃণভূমিতে আছি। এজন্য এখনো ফ্রিজে আইসক্রিম আর কোক দেখলেই মন চায় সাবার করে দিতে।

অনেক বিবর্তনবাদী মনস্তাত্বিক যুক্তি দিয়েছেন, আদিম সংগ্রহকারী গোত্রগুলি একগামী দাম্পত্য সম্পর্কের উপর গড়ে উঠেনি৷ বরং ব্যক্তিগত সম্পদ, পিতৃত্বের দাবি এসব concept ই তখন ছিলো না। যেহেতু কোন পুরুষ জানতো না, তার নিজের সন্তান কোনটি, তাই পুরুষরা সমানভাবে শিশুদের প্রতি যত্নবান হতো। এমনকি বর্তমান বারি ইন্ডিয়ানদের মাঝেও যৌথ পিতৃত্ব রীতি অনুশীলিত হচ্ছে। তৎকালীন সময়ে একজন ভালো মাতার বিভিন্ন পুরুষের সাথে মিলিত হওয়ার যুক্তি আছে, বিশেষ করে সে যখন গর্ভবতী, সে আশা করে তার শিশু অর্জন করবে দক্ষ শিকারী, ভালো গল্পকার, শক্তিশালী যোদ্ধা, সবচেয়ে সহানুভূতিশীলের গুণাবলী। এটা বর্তমান কালে নির্বোধের মত শোনালেও, মনে রাখা উচিত আধুনিক ভ্রূণতত্ত্ব গবেষণার পূর্বে, মানুষের কাছে কোন সুস্পষ্ট প্রমাণ ছিলো না যে একটি শুক্রাণু দ্বারাই একটি ডিম্বাণু নিষিক্ত হয় এবং একজন শিশুর পিতা একজনই। এই "প্রাচীন কমিউন" তত্ত্বের প্রবক্তারা যুক্তি দেন আদিম সংগ্রহকারী গোত্রগুলোর বহুগামিতাই আজকের আধুনিক বিবাহ এবং বিবাহ বিচ্ছেদের উচ্চ হারকে বৈশিষ্ট্য প্রদান করেছে৷ আবার অনেক স্কলার এর ঘোর বিরোধিতাও করেছেন, তারা জোর দিয়েছেন যে একগামিতা এবং দম্পতি কেন্দ্রিক পরিবার গঠন মানুষের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। দুর্ভাগ্যবশত ৭০ হাজার বছর আগের cognitive revolution থেকে ১২ হাজার বছর আগের কৃষি বিপ্লবের খুব বেশি তথ্য আমাদের কাছে নেই। এমনকি প্রাক-কৃষি কালে আমরা যেটাকে প্রস্তরযুগ বলি (stone age), সেটাকে আসলে বলা উচিত কাষ্ঠ যুগ (wood age)। কারণ তখনকার অধিকাংশ হাতিয়ার সরঞ্জাম ছিলো কাষ্ঠ নির্মিত।

প্রাচীন শিকারীদের জীবন কেমন ছিলো তা টিকে থাকা শিল্পকর্মের ভিত্তিতে অনুমান করা কষ্টসাধ্য। কারণ এমনিতেই তারা ছিলো যাযাবর, তাই অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জিনিসের বাইরে কিছু নেওয়ার বিলাসিতা তারা করতে পারতো না। আর বর্তমান যুগের শিকারী সংগ্রহকারী সমাজ থেকে প্রস্তর যুগের সমাজকে অনুধাবন করতে গেলে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন, কারণ আধুনিক শিকারী সমাজ কৃষি এবং শিল্প দ্বারা প্রভাবিত। আর একই অঞ্চলেই শিকারী যাযাবর সমাজ অনেক পৃথক হয়, যেমন বৃটিশ বিজয়ের আগে অষ্ট্রেলিয়ায় ২০০-৬০০ উপজাতি ছিলো যাদের প্রত্যেকের ভাষা, ধর্ম, প্রথা ছিলো ভিন্ন। ১২০০০ বছর আগে কৃষিবিপ্লবের পর ৫০ থেকে ৮০ লক্ষ শিকারী যাযাবর সর্বত্র ছড়িয়ে পরেছিলো হাজার হাজার ভিন্ন ভাষা আর সংস্কৃতি নিয়ে। এটা Cognitive Revolution এর প্রথম অর্জন এবং মিথকে ধন্যবাদ কারণ একই জেনেটিক বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও মানুষ একই পরিবেশে ভিন্ন বাস্তবতা তৈরীতে সক্ষম হয়েছিলো, যা তাদের ভিন্ন নিয়ম ও মূল্যবোধে বিকশিত করেছিলো। Cognitive Revolution এর পর sapiens এর জীবনের কোন একক রাস্তা ছিলো না । অনেকগুলো সম্ভাবনার ক্ষেত্র থেকে শুধু সাংস্কৃতিক নির্বাচনটাই আমরা করেছিলাম৷

কৃষি বিপ্লবের পূর্বে sapiens দের বেশ কিছু অর্জন রয়েছে৷ ১৫ হাজার বছর পূর্বে আমরা কুকুরকে পোষ মানাতে শিখি। যেসব কুকুর মানব সঙ্গীদের চাহিদা এবং অনুভূতির প্রতি অত্যন্ত মনোযোগী ছিলো তারা বিশেষ যত্ন এবং খাবার লাভ করতো, তাই তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ছিলো বেশি। একইভাবে কুকুররাও আমাদের থেকে নিপুণভাবে নিজেদের প্রয়োজন আদায় করতে শিখেছিলো।

ওই সময় একই গোত্রের সদস্যরা একসাথে শিকার করতো, ধর্মীয় উৎসব পালন করতো, পণ্য বেচাকেনা করতো, তবে বাণিজ্য অভিজাত পণ্যের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিলো, যেমন - ঝিনুক, এম্বার, রঞ্জক। তবে সেটা একই গোত্রের মাঝে হতো, ভিন্ন গোত্রের মাঝে হওয়ার প্রমাণ নেই। ভিন্ন গোত্রে সামাজিক রাজনৈতিক সম্পর্কও জোরালো ছিলো না। একজন সাধারণ মানব নিজ গোত্রের সদস্য ছাড়া দীর্ঘ সময় কারো সাথে সাক্ষাত না করে কাটিয়েছে। তবে কখনো কখনো দলগুলি নতুন ভূখন্ড, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সহিংস দ্বন্দ্ব ইত্যাদি কারণে বিচরণভূমির বাইরে যেত এবং এভাবে তারা ছড়িয়ে পরলো বিশ্বব্যাপী। সামুদ্রিক খাদ্য এবং জলচর পাখির জন্য স্থায়ী জেলেপাড়া গঠিত হয়েছিলো কৃষিবিপ্লবের আগেই। ৪৫ হাজার বছর আগে ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপগুলোতে জেলেপাড়া গড়ে উঠে, সম্ভবত এখান থেকেই তারা প্রথম সাগর পার হয়ে অস্ট্রেলিয়ায় পৌছায়।

সেপিয়েন্সরা কেবল খাদ্যের জন্য ঘুরে বেড়াতো তা নয়, ঘুরে ঘুরে তারা জ্ঞানও অর্জন করতো। বরং আধুনিককালে আমাদের নিজেদের ক্ষেত্র ছাড়া জ্ঞান অল্প, জীবনের বাকি বড় অংশে অন্যের জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল৷ সমষ্টিগতভাবে আমরা আদিম মানবদের থেকে অনেক বেশি জানি। কিন্তু ব্যাক্তি পর্যায়ে আদিম শিকারী সংগ্রহকারীরা ছিলো অলরাউন্ডার, ইতিহাসের সবচেয়ে জ্ঞানী এবং দক্ষতাপূর্ণ মানুষ।

কিছু প্রমাণ পাওয়া যায় যে সেপিয়েন্সের মস্তিষ্ক যাযাবর যুগের পর থেকে ছোট হয়ে এসেছে৷ সেই যুগে বেচে থাকার জন্য অসাধারণ মানসিক উৎকর্ষের প্রয়োজন ছিলো। সচরাচর দুর্বলরা টিকে থাকতে পারতো না। শিল্পে অগ্রগতির পর মানুষ বেচে থাকার জন্য ক্রমেই অন্যদের দক্ষতার উপর নির্ভর করতে থাকলো, তাই দুর্বলরাও টিকে থাকা শুরু করলো, সামান্য স্টেডিয়ামের পানি টানার লোকও কাজ করে বেচে থেকে তার বিশেষত্বহীন জিন পরবর্তী প্রজন্মে স্থানান্তর করার সুযোগ পেলো। যাযাবররা ঘাসের শব্দ শুনেও বুঝতো একটা সাপ ওৎ পেতে আছে। তাদের শারীরিক যোগ্যতা আধুনিক মানুষ বছরের পর বছর ব্যায়াম করেও পাবে না।

এবং প্রস্তর যুগের যাযাবররা আমাদের থেকে আরামদায়ক এবং সন্তোষজনক জীবনযাপন করতো বলে মনে হয়। আজ উন্নয়নশীল বিশ্বে মানুষকে ৬০-৮০ ঘন্টা কাজ করতে হয় যেখানে অত্যন্ত বৈরী পরিবেশে কালাহারী মরুভূমিতে বর্তমান যাযাবররা ৩৫-৪৫ ঘন্টা কাজ করছে৷ ফসিল থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় আদিম যাযাবররা অনাহার এবং অপুষ্টিতে কম ভুগেছে এবং তারা ছিলো উত্তরসূরি কৃষকগোষ্ঠীর চেয়ে স্বাস্থ্যবান এবং লম্বা৷ গড় আয়ু ৩০-৪০ বছর হলেও এর কারণ শিশু মৃত্যুহার, কেউ কেউ ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচতো৷ তাদের খাদ্যতালিকা শুরুর দিকের কৃষিভিত্তিক সমাজের থেকে বৈচিত্র্যময় ছিলো তাই তাদের সব ধরণের পুষ্টি নিশ্চিত হতো। খরা বা ভূমিকম্পে তারা কৃষিভিত্তিক সমাজের মত অনাহারে বিপর্যস্ত হতো না, কারণ তাদের খাদ্যের বিকল্প উৎস সবসময় প্রস্তুত থাকতো। আদিম যাযাবররা মহামারী রোগেরও শিকার হতো না কারণ তারা ঘনবসতিতে থাকতো না


তবে এই আদিম মানুষের জীবনকে আদর্শ মনে করা ভুল হবে। তারা মাঝেমধ্যে বৃদ্ধ ও অক্ষম লোকদের পরিত্যাগ করতো এবং হত্যা করতো। ১৯৬০ দশকে Ache গোষ্ঠীর থেকে তাদের পূর্বপুরুষ যাযাবরদের অন্ধকার দিক জানা যায়। কোন বৃদ্ধা মহিলা দলের অন্য সকলের জন্য বোঝা হয়ে উঠতো, তরুণদের কেউ চুপিসারে পিছে গিয়ে মাথায় কুঠারের আঘাতে তাকে হত্যা করতো। কন্যা সন্তানকে হত্যা করা হতো, এমনকি কান্না করার জন্যও বাচ্চাকে হত্যা করার ঘটনা আছে, চেহারা হাস্যকর বলে বাচ্চাকে জীবন্ত কবর দেওয়ার উদাহরণ আছে। নারী এবং পুরুষ উভয়েরই সঙ্গী বদলানোর স্বাধীনতা ছিলো। তবে তাই বলে তাদের দ্রুত মূল্যায়ন করা ঠিক হবে না। তাদের মাঝে শ্রেণিবিভেদ ছিলো না, সামান্য সম্পদ থাকা সত্ত্বেও উদার ছিলো। এটিও উল্লেখ করা উচিত যে প্যারাগুয়ের কৃষকরা নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে Ache দের হত্যা করেছিলো। তারা কোন উপন্যাসের চরিত্রের মত শতভাগ ভালো বা শতভাগ খারাপ ছিলো না। Ache রা স্বর্গদূত বা শয়তান কোনটাই ছিলো না, তারা ছিলো শুধুই মানুষ।

আদিম শিকারী সংগ্রহকারীরা সর্বপ্রাণবাদী ছিলো। সর্বপ্রাণবাদ কোন নির্দিষ্ট ধর্ম নয়, এটি হাজার হাজার প্রথা, ধর্ম, বিশ্বাসের জাতিবাচক নাম। সর্বপ্রাণবাদে বিশ্বাসীরা মনে করে যে প্রায় সব স্থান, প্রাণী, উদ্ভিদ এবং প্রাকৃতিক ঘটনার মাঝে রয়েছে সচেতনতা এবং অনুভূতি, আর তারা মানুষের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে সক্ষম। যেমন তারা মনে করে, বিশাল পাথরের খন্ডেরও কিছু আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদা রয়েছে৷ সর্বপ্রাণবাদী আদিম মানুষের এই বিশ্বাস ও অনুশীলনের পার্থক্য ছিলো বিশাল, তাদের ধর্মীয় অভিজ্ঞতা ছিলো অসংযত এবং বিতর্কিত, সংস্কার ও বিপ্লব দিয়ে পরিপূর্ণ। কিন্তু তাদের ধর্ম নিয়ে এর চেয়ে বেশি তথ্য আমাদের কাছে নেই, তারা সর্বপ্রাণবাদী ছিলো এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য না। তাদের দেবতা, উৎসব, বিধিনিষেধ কোনটাই আমরা জানি না। তাদের কোন সাংস্কৃতিক বিশ্বাসের ব্যাখ্যা আমাদের কাছে নেই।তবে আমরা যতই কম জানি না কেন, অন্তত এটা প্রমাণিত যে ৩০ হাজার বছর পূর্বে সেপিয়েন্সরা সামাজিক-রাজনৈতিক নিয়মাবলীর সূচনা করেছিলো যা অন্যান্য প্রজাতির মানব ও প্রাণীর আচরণের প্যাটার্ন থেকে অনেক পৃথক হয়ে গিয়েছিলো।

কৃষিবিপ্লবের আগে শান্তিপূর্ণ অবস্থা বজায় ছিলো নাকি সহিংসতা রাজ করেছিলো এ বিষয়েও পূর্ণ তথ্য নেই। প্রাক-শিল্পযুগে ৯০ শতাংশ মানুষ অস্ত্রাঘাতের চেয়ে ক্ষুধা, ঠান্ডা এবং রোগে বেশি মারা গিয়েছিলো। তবে এটা শান্তিপূর্ণ অবস্থা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ঠ নয়, এমনও হতে পারে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বিতাড়িত হবার পর দুর্গম অঞ্চলে খাদ্যাভাবে এবং বৈরী আবহাওয়ায় তাদের মৃত্যু হয়। দানিয়ুব উপত্যকায় পাওয়া ৪০০ কঙ্কালের মাঝে ১৮ টি কঙ্কালে সহিংসতার প্রমাণ পাওয়া যায়, যা ৪.৫% অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর কাছাকাছি প্রায়। উল্লেখ্য, বিংশ শতাব্দীতে সবচেয়ে বেশি যুদ্ধ এবং গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। যাযাবররা ধর্ম এবং সামাজিক কাঠামোর দিক দিয়ে ব্যাপক উন্নতি লাভ করেছিলো, তারা সম্ভবত বিভিন্ন মাত্রায় সহিংসতা প্রদর্শন করেছে। কিছু অঞ্চলে হয়তো শান্তিপূর্ণ অবস্থা বজায় ছিলো, অন্য সময় হিংস্র দ্বন্দ্বে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়েছিলো।

ফসিল হওয়া হাড়গোড় এবং হাতিয়ার থেকে শারীরিক গঠন, প্রযুক্তি, খাদ্যাভ্যাস সংক্রান্ত তথ্য জানা গেলেও ধর্মীয় উন্মাদনা, দার্শনিক তত্ত্ব, সংগীত, বাণী প্রচার এসব সম্পর্কে জানা যায় না। যেন ঐ সময় আর আধুনিক কালের মাঝে রয়েছে এক নীরবতার পর্দা যা এতই পুরু যে এই ধরণের ঘটনা আদৌ ঘটেছে কিনা নিশ্চিত হতে পারি না, বিস্তারিত বর্ণনা দূরের কথা।

The Flood

সেপিয়েন্সরা ৪৫ হাজার বছর আগে যখন প্রথম অস্ট্রেলিয়া যায়, তখন ছিলো মারসুপিয়াল সিংহ, উটপাখির দ্বিগুণ আকারের কোয়ালা, ড্রাগনের মত দেখতে লিজার্ড, পাঁচ মিটার লম্বা সর্পকূল, দৈত্যাকার ডিপ্রোটোডন, আড়াই টনের ওমব্যাটের বিচরণ। এরপর কয়েক হাজার বছরের মাঝে ৫০ কেজির বেশি ওজনের ২৪ টি প্রজাতির মাঝে ২৩ টিই বিলুপ্ত হয়ে যায়। সমগ্র অষ্ট্রেলিয়ার বাস্তুসংস্থানের খাদ্য শৃঙ্খলা ভেঙ্গে যায় এবং পুনর্বিন্যাস হয়। এর জন্য কি হোমোস্যাপিয়েন্স একাই দায়ী?

কিছু গবেষক সেপিয়েন্সের দোষক্ষালন করার জন্য জলবায়ুর উপর দোষ চাপান। কিন্তু জলবায়ুর পরিবর্তনেও প্রাণীগুলোর টিকে থাকার ইতিহাস আছে। প্রতি এক লক্ষ বছরে পৃথিবীকে একটি বরফ যুগ মোকাবেলা করতে হয়েছে। অষ্ট্রেলিয়ায় ১৫ লক্ষ বছর আগে ডিপ্রটোডনের আগমন ঘটেছিলো যারা অন্তত দশটি বরফ যুগ অতিক্রম করেছিলো। আর ঠিক যে সময়েই মানুষ অষ্ট্রেলিয়া প্রবেশ করে, তখনই জলবায়ুর পরিবর্তনে সবাই মারা যায় এটা মেনে নেওয়া কষ্টকর৷ আর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সামুদ্রিক প্রাণীর উপরও পরবে, কিন্তু ওই সময় সামুদ্রিক প্রাণীজগতে কোন প্রজাতির বিলুপ্তির প্রমাণ নেই। আর মানুষ এরপর যেখানেই গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করেছে, সেখানেই এমন বিলুপ্তি দেখা গিয়েছে, এমন নজির অসংখ্য রয়েছে। সুতরাং, ইতিহাসের নথি sapiens কে ইকোলজিক্যাল সিরিয়াল কিলার হিসেবে সাব্যস্ত করে।

এখন প্রশ্ন হলো কেবল প্রস্তর যুগের প্রযুক্তি দিয়ে কিভাবে এমন পরিবেশ বিপর্যয় ঘটানো সম্ভব? অষ্ট্রেলিয়ার বড় আকারের প্রাণীর বংশবিস্তার ছিলো খুবই ধীর, গর্ভকাল ছিলো দীর্ঘ, প্রতি গর্ভে সন্তানের সংখ্যা হতো অল্প। তাই কয়েক মাস পরপর একটি ডিপ্রটোডন হত্যা করলেও সেটা তাদের বিলুপ্তির জন্য যথেষ্ট। আর বৃহৎ প্রাণীগুলো অষ্ট্রেলিয়া থেকে পালিয়ে যাওয়ারও সুযোগ ছিলো না। আর তারা মানুষের শারীরিক গঠন দেখে ভয়ও পেতো না, বানর সদৃশ দুর্বল প্রাণীটির দিকে তকিয়ে আবার লতাপাতা চিবানোয় মন দিতো। মানবজাতি সম্পর্কে ভয়ের ধারণা বিবর্তিত হওয়ার পূর্বেই তারা বেঘোরে বিলুপ্ত হয়ে গেলো। এছাড়া মানবজাতি আগুন দিয়ে জঙ্গল পুড়িয়ে তৃণভূমি তৈরী করেছিলো। অষ্ট্রেলিয়ায় ৪৫ হাজার বছর আগে ইউক্যালিপটাস বিরল ছিলো, কিন্তু মানুষ তৃণভূমি তৈরীর পর এই উদ্ভিদের স্বর্ণযুগ তৈরী হয়।

হোমো সেপিয়েন্সরা ছিলো প্রথম এবং একমাত্র মানব প্রজাতি যারা বর্তমান আমেরিকার ভূখন্ডে পৌছে গিয়েছিলো ১৬ হাজার বছর আগে। তারা পায়ে হেটে যেতে পেরেছিলো কারণ সেই সময় সমুদ্রতল এত নিচে নেমে গিয়েছিলো যে সাইবেরিয়া এবং উত্তর পশ্চিম আলাস্কার সঙ্গে ভূমির সংযোগ ঘটেছিলো। এটি মোটেও সহজ ছিলো না, কারণ সেপিয়েন্সকে শিখতে হয়েছিলো কিভাবে সাইবেরিয়ার চরম মেরু পরিবেশে টিকে থাকতে হয়৷ কিন্তু উষ্ণ তৃণভূমিতে অভিযোজিত হওয়া সেপিয়েন্সরা বিচক্ষণ সমাধান উদ্ভাবন করেছিলো মোটা পোশাক তৈরীর ক্ষমতা অর্জন করে।

কিন্তু তারা এত কষ্ট স্বীকার করে কেন সাইবেরিয়ার পথে রওয়ানা দিলো? হয়তো যুদ্ধ, জনসংখ্যার চাপ প্রাকৃতিক বিপর্যয় তাদের উত্তরে যেতে বাধ্য করেছিলো। মেরু অঞ্চলের এক একটা বিশাল ম্যামথ থেকে প্রচুর প্রাণীজ আমিষ পাওয়া যেত এবং শীতল পরিবেশে সংরক্ষণ করাও সহজ ছিলো। সেপিয়েন্সরা ১৬ হাজার বছর আগে যখন আলাস্কা যায় তখন তারা জানতোও না যে নতুন এক বিশ্ব আবিষ্কার করেছে। ১৪ হাজার বছর পূর্বে বরফ গলে একটি সহজ পথ উন্মুক্ত হলে মানব প্রজাতি দক্ষিণে প্রবেশ করতে থাকে, মহাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পরে। অন্য কোন প্রাণী এত বিপুল বৈচিত্র‍্যপূর্ণ বিভিন্ন আবাসস্থল এত দ্রুত পরিবর্তন কখনোই করে নি, কার্যত একই জিন নিয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে পরতে পারে নি৷

আমেরিকা বিজয় কোন রক্তপাতহীন বিজয় ছিলো না। ১৪ হাজার বছর আগে ওই সময় ম্যমথ, ম্যাষ্টোডন, ভাল্লুক, ঘোড়া, উট, বিশাল আকারের সিংহ, আট টনের ৬ ফুট উচু স্তন্যপায়ী স্লথ বিচরণ করতো। সেপিয়েন্স আসার দুই হাজার বছরের মাঝে উত্তর আমেরিকায় ৪৭ টি স্তন্যপায়ীর ৩৪ টি আর দক্ষিণ আমেরিকায় ৬০ টি প্রজাতির মাঝে ৫০ টি বিলুপ্ত হয়ে যায়। অষ্ট্রেলিয়ার মত আমেরিকাতেও সেপিয়েন্সের প্রকোপে ইকোলজিক্যাল সিস্টেম চেঞ্জ হিয়ে যায়। আফ্রিকার মূল ভূখন্ড থেকে ৪০০ কিলোমিটার দূরে মাদাগাস্কারে মাত্র ১৫০০ বছর আগে যখন মানুষ প্রবেশ করে, গ্রহের বৃহত্তম প্রাইমেট লেমুর, বৃহত্তম পাখি আধা টন ওজনের এলিফ্যান্ট বার্ড সব বিলুপ্ত হয়ে গেলো।

সেপিয়েন্সের বসতি স্থাপনের প্রথম তরঙ্গটি ছিলো প্রাণীজগতের জন্য বৃহত্তম ও দ্রুততম পরিবেশগত বিপর্যয়৷ হোমো সেপিয়েন্সরা এই গ্রহের বড় প্রাণীর অর্ধেক নিশ্চিহ্ন করে দেয় চাকা আবিষ্কার, লিখন বা লোহার হাতিয়ার আবিষ্কারের অনেক আগেই। আমরা আধুনিক মানুষরাই শুধু পাপী না, বিলুপ্তির প্রথম ঢেউটি আসে যখন শিকারী সংগ্রহকারীরা ছড়িয়ে পরে প্রস্তর যুগে৷ বিলুপ্তির দ্বিতীয় ঢেউ আসে কৃষকরা যখন ছড়িয়ে পরে কৃষি বিপ্লবের পর৷ আর বিলুপ্তির তৃতীয় ঢেউ এর জন্য দায়ী বর্তমান আমাদের শিল্পবিপ্লব। এইরকম গতিতে চলতে থাকলে তিমি, হাঙ্গর, টুনা, ডলফিনরাও ডিপ্রটোডন, স্লথের ভাগ্য অনুসরণ করে হারিয়ে যাবে৷


Popular Posts